শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সন্তানকে বাচাঁতেই শিকলবন্দি করেছেন মা!

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৯:৪৭:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জুলাই ২০২০
  • ৫৭ Time View

 

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

বন্যার পানিতে ডুবে আছে পুরো গ্রাম। পাকা-কাঁচা রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, মাদরাসাসহ পুরো এলাকার ঘরবাড়ি হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে আছে। অবশ্য পুরো এলাকার মধ্যে স্থানীয় ছোট্ট একটি বাজারের ১০-১২টি দোকান এখনো জেগে আছে পানির ওপরে। বাজারের খানিকটা দূরে চারিদিকে পানি দিয়ে ঘেরা একটি আধা নির্মিত ইটের দেয়ালের ওপরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে অপ্রকৃতস্থ এক কিশোরকে। বন্যার পানিতে বারবার নামার চেষ্টা করছিল শিকলে বাঁধা অপ্রকৃতস্থ কিশোরটি। কিন্তু বেঁধে রাখা শিকলের টানে সে ব্যর্থ হচ্ছিল। প্রথমে দৃশ্যটি অমানবিক মনে হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেল সন্তানের প্রাণ বাঁচাতেই এক শ্রমজিবী মা এ ব্যবস্থা নিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলী গ্রামসহ অন্তত তিন শতাধিক ঘরবাড়ি প্রায় এক মাস ধরে পানির নিচে। কথা হয় এই গ্রামের মা হালিমা খাতুন সুন্দরীর সাথে। তাঁর ডুবে যাওয়া ঘরের চৌকিতে বসে তখন তিনি সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আলাপচারিতার একপর্যায়ে জানালেন তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে।
বড় ছেলে হাফিজুর রহমান জন্ম থেকেই মানসিক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রায় পাঁচ বছর ধরে বখাটে স্বামী কাইয়ুমের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। প্রতিবন্ধী ছেলে হাফিজুর, এক মেয়ে আর এক শিশু ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলে হাফিজুরের দূরন্তপনার কারণে বিরক্ত হয়ে প্রায়ই আশেপাশের প্রতিবেশীরা তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে ছাড়ে না। তাছাড়া মাঝে মধ্যেই বাজারে গিয়ে দোকানিদের বিরক্ত করে থাকে। যার খেসারত হিসেবে হাফিজুর গুনতে হয় শারীরিক যন্ত্রণা।
অসহায় এই মায়ের ভাষায় প্রতিদিন বাইরে থেকে হাফিজুর বাড়ি ফিরলেই সন্তানের অগোছালো আর অস্পষ্ট ভাষায় তাকে শুনতে হয় “মা ব্যাতা ব্যাতা”। চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না অসহায় এই মায়ের। তিনি জানালেন, এই এলাকায় সকলেই তাঁত ব্যবসার সাথে জড়িত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে গত ৪ মাস ধরে এলাকার সকল তাঁত কারখানা বন্ধ, তার উপরে এসেছে বন্যা। যে কারণে সন্তানদের নিয়ে এখন তার খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছে। তার উপরে প্রতিবন্ধী ছেলে হাফিজুরের নানা আবদার তাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছ। তার নানা কাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগে প্রায়ই হাফিজুর পানির মধ্য দিয়ে বাইরে চলে যায়। সাঁতার না জানায় ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে সারাক্ষণ। তাই তাকে শিকলবন্দি করে রেখেছেন।

বিষয়টি অমানবিক কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্দ কণ্ঠে হালিমা জানান, আমার সন্তানের ভাল আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে? তিনি জানালেন, আমি ১৭ বছর ধরে হাফিজুরকে লালন পালন করছি। কেউই কোন ভাবে তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে নাই। তাছাড়া এই ভরা বন্যায় তার অপ্রকৃতস্থ সন্তানের পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ও রয়েছে। তার ভাষায়, বড় বড় কথা অনেকেই বলে কিন্তু উপকার করতে কেউই আগে এগিয়ে আসে না। আমি আমার নাড়ি ছেঁড়া এই সন্তানকে বাঁচানোর জন্যই এই ব্যবস্থা করেছি।

Tag :

সন্তানকে বাচাঁতেই শিকলবন্দি করেছেন মা!

Update Time : ০৯:৪৭:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জুলাই ২০২০

 

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

বন্যার পানিতে ডুবে আছে পুরো গ্রাম। পাকা-কাঁচা রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, মাদরাসাসহ পুরো এলাকার ঘরবাড়ি হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে আছে। অবশ্য পুরো এলাকার মধ্যে স্থানীয় ছোট্ট একটি বাজারের ১০-১২টি দোকান এখনো জেগে আছে পানির ওপরে। বাজারের খানিকটা দূরে চারিদিকে পানি দিয়ে ঘেরা একটি আধা নির্মিত ইটের দেয়ালের ওপরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে অপ্রকৃতস্থ এক কিশোরকে। বন্যার পানিতে বারবার নামার চেষ্টা করছিল শিকলে বাঁধা অপ্রকৃতস্থ কিশোরটি। কিন্তু বেঁধে রাখা শিকলের টানে সে ব্যর্থ হচ্ছিল। প্রথমে দৃশ্যটি অমানবিক মনে হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেল সন্তানের প্রাণ বাঁচাতেই এক শ্রমজিবী মা এ ব্যবস্থা নিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলী গ্রামসহ অন্তত তিন শতাধিক ঘরবাড়ি প্রায় এক মাস ধরে পানির নিচে। কথা হয় এই গ্রামের মা হালিমা খাতুন সুন্দরীর সাথে। তাঁর ডুবে যাওয়া ঘরের চৌকিতে বসে তখন তিনি সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আলাপচারিতার একপর্যায়ে জানালেন তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে।
বড় ছেলে হাফিজুর রহমান জন্ম থেকেই মানসিক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রায় পাঁচ বছর ধরে বখাটে স্বামী কাইয়ুমের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। প্রতিবন্ধী ছেলে হাফিজুর, এক মেয়ে আর এক শিশু ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলে হাফিজুরের দূরন্তপনার কারণে বিরক্ত হয়ে প্রায়ই আশেপাশের প্রতিবেশীরা তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে ছাড়ে না। তাছাড়া মাঝে মধ্যেই বাজারে গিয়ে দোকানিদের বিরক্ত করে থাকে। যার খেসারত হিসেবে হাফিজুর গুনতে হয় শারীরিক যন্ত্রণা।
অসহায় এই মায়ের ভাষায় প্রতিদিন বাইরে থেকে হাফিজুর বাড়ি ফিরলেই সন্তানের অগোছালো আর অস্পষ্ট ভাষায় তাকে শুনতে হয় “মা ব্যাতা ব্যাতা”। চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না অসহায় এই মায়ের। তিনি জানালেন, এই এলাকায় সকলেই তাঁত ব্যবসার সাথে জড়িত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে গত ৪ মাস ধরে এলাকার সকল তাঁত কারখানা বন্ধ, তার উপরে এসেছে বন্যা। যে কারণে সন্তানদের নিয়ে এখন তার খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছে। তার উপরে প্রতিবন্ধী ছেলে হাফিজুরের নানা আবদার তাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছ। তার নানা কাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগে প্রায়ই হাফিজুর পানির মধ্য দিয়ে বাইরে চলে যায়। সাঁতার না জানায় ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে সারাক্ষণ। তাই তাকে শিকলবন্দি করে রেখেছেন।

বিষয়টি অমানবিক কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্দ কণ্ঠে হালিমা জানান, আমার সন্তানের ভাল আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে? তিনি জানালেন, আমি ১৭ বছর ধরে হাফিজুরকে লালন পালন করছি। কেউই কোন ভাবে তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে নাই। তাছাড়া এই ভরা বন্যায় তার অপ্রকৃতস্থ সন্তানের পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ও রয়েছে। তার ভাষায়, বড় বড় কথা অনেকেই বলে কিন্তু উপকার করতে কেউই আগে এগিয়ে আসে না। আমি আমার নাড়ি ছেঁড়া এই সন্তানকে বাঁচানোর জন্যই এই ব্যবস্থা করেছি।