শাহানা হুদা রঞ্জনা.
” শুরু থেকেই রোজিনার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিহিংসার ভাব লক্ষ্য করছি। শেষপর্যন্ত প্রতিহিংসাই জয়ী হলো। তবে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, রোজিনার প্রতি প্রতিহিংসাটা কাদের বেশি? এত ক্ষোভ শুধু কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজের? প্রশাসন যন্ত্রের? নাকি অন্য কারো? “
‘‘যারা শাসিত হয় অর্থাৎ জনগণ, সংবাদমাধ্যম তাদের সেবার জন্য, যারা শাসন করে তাদের সেবার জন্য নয়। সংবাদমাধ্যমকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা রাষ্ট্রের গোপন তথ্য জনগনকে জানাতে পারে। শুধু মুক্ত সংবাদমাধ্যমই সরকারের প্রতারণাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে” কথাগুলো বলেছিলেন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হুগো ব্ল্যাক ১৯৭১ সালে।
এই রায়ের একটি প্রেক্ষিত আছে। আমেরিকা ও ভিয়েতনামের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি রবার্ট ম্যাকনামারা ভিয়েতনাম সংক্রান্ত সকল রাষ্ট্রীয় তথ্য, বিভিন্ন মেমো, নোট, সিদ্ধান্ত ও রিপোর্ট একত্র করে সংগ্রহ করেন। এটি ছিল একটি ৩,০০০ পাতার রিপোর্ট ও ৪,০০০ পাতার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোপনীয় দলিল। সর্বমোট ৪৭ ভলিউমের এই রিপোর্ট ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গোপনীয় দলিল যা ”পেন্টাগন পেপারস” নামে পরিচিত।
এই নথি নিয়ে কাজ করছিল ড্যানিয়েল এলসবার্গ নামে একজন অর্থনীতিবিদ, পলিসি ও সিদ্ধান্ত বিষয়ক গবেষক এবং একটিভিষ্ট। একসময় তিনি বুঝতে পারেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ আসলে ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধ নয়, এটা আমেরিকার ১৯৪৫ সাল থেকে করা পরিকল্পনার অংশ। আমেরিকা যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয় ও ক্ষতির মুখে, তখনও তারা নিয়মিত মিথ্যা বলে যাচ্ছিল জনগণের কাছে। এলসবার্গ বুঝতে পারেন ১৯৪৫ থেকে আমেরিকার সব প্রেসিডেন্ট এই মিথ্যা বলেছেন জনগণ ও সিনেটের কাছে।
এলসবার্গ ভিয়েতনাম গিয়ে দেখলেন সেখানকার প্রকৃত অবস্থা আর আমেরিকার নেতৃবৃন্দ যা বলছেন তার ভেতরে আকাশ পাতাল তফাত। তখন ভিয়েতনাম থেকে ফিরে এসে, একদিন রাতে তাই তিনি ৪৭ ভলিউমের এই গুরুত্বপূর্ণ অতি গোপনীয় দলিলের ৪০টি ভলিউম কপি করে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিকের হাতে তুলে দেন।
জুন ১৩, ১৯৭১ এর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় রাষ্ট্রের নেতৃবর্গের এই সিস্টেম্যাটিক মিথ্যার কথা প্রকাশ শুরু হয়। সাথে সাথে মার্কিন এটর্নি জেনারেল ও নিক্সন প্রশাসন আদালত থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশনা নিষিদ্ধের সমন জারিতে সক্ষম হয়। পরদিন ওয়াশিংটন পোস্টও সেটা প্রকাশ করে।
এর পর মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে এটা নিয়ে মামলা ওঠে যেটাতে পত্রিকাগুলো জুরিদের ৬-৩ ভোটে বিজয় লাভ করে। রায়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হুগো ব্ল্যাক তখন এই কথাগুলো বলেছিলেন। রোজিনা ইসলামের জামিন নামঞ্জুর, আবার শুনানি, শুনানির দুইদিন পর জামিন বিষয়ে আদেশ দেয়ার কথা বলে রোজিনাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ার পর বিচারপতি হুগো ব্ল্যাকের রায়ের এই কথাগুলো এখন ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অবরুদ্ধ। পেশাগত জীবনে সাড়া জাগানো এই মেয়েটি আজ যেমন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাঁদছে, অন্যদিকে হতবাক হয়ে অপেক্ষা করছে রোজিনার বৃদ্ধা মা ও ১১ বছরের মেয়েটি।
যে শিশুটি মায়ের অর্জনের জন্য গর্বিত, যে শিশুটি দেখে এসেছে মা মানুষের ভালোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে, মা দেশে-বিদেশে কাজের জন্য সুখ্যাতি পাচ্ছে, সেই শিশুকে কে বলবে, তার মমতাময়ী মা কাজ করতে গিয়ে ‘‘তথ্য চুরির” অভিযোগে কয়েদখানায়। সবাই ওর কাছে মায়ের এই বিপদের তথ্য গোপন করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এক রাতে মেয়েটি বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছে,‘‘বাবা আমাকে মিথ্যা বলোনা। আমি সব জেনেছি। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বলে ইউটিউবে একবার দেখে আর দেখিনি।”
একজন নারী ও নাবালিকা সন্তানের মা হিসেবে রোজিনার জামিন পাওয়াটা অধিকার। এই অধিকার কেড়ে নেয়া হলো কেন? তিনি কি তথ্য-প্রমাণাদি নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, সাক্ষীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন অথবা বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পালানোর চেষ্টা করেছেন? সবচেয়ে বড়কথা যে ধারাগুলোতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তা সবই জামিনযোগ্য। অথচ আজকে আমরা সবাই অনিশ্চয়তাপূর্ণ আশ্বাসের মুখোমুখি।
গত ২০ বছরে ভারতে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও আদালতে তা খারিজ হয়ে যায়। ভারতের মন্ত্রিসভার গোপন নথি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর শান্তনু সাইকিয়া একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়। সেই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট বলেছিল, কোন নথি ফাঁস হলে সেটাকে ”গোপন” আখ্যা দিয়ে কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অধীনে মামলা করা যায় না।