শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

দৃশ্যমান দাবির চাইতে অদৃশ্য শক্তির জোর কি বেশি !

  • Reporter Name
  • Update Time : ১১:২৮:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ মে ২০২১
  • ৬৮ Time View

শাহানা হুদা রঞ্জনা.

শুরু থেকেই রোজিনার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিহিংসার ভাব লক্ষ্য করছি। শেষপর্যন্ত প্রতিহিংসাই জয়ী হলো। তবে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, রোজিনার প্রতি প্রতিহিংসাটা কাদের বেশি? এত ক্ষোভ শুধু কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজের? প্রশাসন যন্ত্রের? নাকি অন্য কারো? “

‘‘যারা শাসিত হয় অর্থাৎ জনগণ, সংবাদমাধ্যম তাদের সেবার জন্য, যারা শাসন করে তাদের সেবার জন্য নয়। সংবাদমাধ্যমকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা রাষ্ট্রের গোপন তথ্য জনগনকে জানাতে পারে। শুধু মুক্ত সংবাদমাধ্যমই সরকারের প্রতারণাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে” কথাগুলো বলেছিলেন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হুগো ব্ল্যাক ১৯৭১ সালে।

এই রায়ের একটি প্রেক্ষিত আছে। আমেরিকা ও ভিয়েতনামের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি রবার্ট ম্যাকনামারা ভিয়েতনাম সংক্রান্ত সকল রাষ্ট্রীয় তথ্য, বিভিন্ন মেমো, নোট, সিদ্ধান্ত ও রিপোর্ট একত্র করে সংগ্রহ করেন। এটি ছিল একটি ৩,০০০ পাতার রিপোর্ট ও ৪,০০০ পাতার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোপনীয় দলিল। সর্বমোট ৪৭ ভলিউমের এই রিপোর্ট ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গোপনীয় দলিল যা ”পেন্টাগন পেপারস” নামে পরিচিত।

এই নথি নিয়ে কাজ করছিল ড্যানিয়েল এলসবার্গ নামে একজন অর্থনীতিবিদ, পলিসি ও সিদ্ধান্ত বিষয়ক গবেষক এবং একটিভিষ্ট। একসময় তিনি বুঝতে পারেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ আসলে ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধ নয়, এটা আমেরিকার ১৯৪৫ সাল থেকে করা পরিকল্পনার অংশ। আমেরিকা যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয় ও ক্ষতির মুখে, তখনও তারা নিয়মিত মিথ্যা বলে যাচ্ছিল জনগণের কাছে। এলসবার্গ বুঝতে পারেন ১৯৪৫ থেকে আমেরিকার সব প্রেসিডেন্ট এই মিথ্যা বলেছেন জনগণ ও সিনেটের কাছে।

এলসবার্গ ভিয়েতনাম গিয়ে দেখলেন সেখানকার প্রকৃত অবস্থা আর আমেরিকার নেতৃবৃন্দ যা বলছেন তার ভেতরে আকাশ পাতাল তফাত। তখন ভিয়েতনাম থেকে ফিরে এসে, একদিন রাতে তাই তিনি ৪৭ ভলিউমের এই গুরুত্বপূর্ণ অতি গোপনীয় দলিলের ৪০টি ভলিউম কপি করে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিকের হাতে তুলে দেন।
জুন ১৩, ১৯৭১ এর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় রাষ্ট্রের নেতৃবর্গের এই সিস্টেম্যাটিক মিথ্যার কথা প্রকাশ শুরু হয়। সাথে সাথে মার্কিন এটর্নি জেনারেল ও নিক্সন প্রশাসন আদালত থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশনা নিষিদ্ধের সমন জারিতে সক্ষম হয়। পরদিন ওয়াশিংটন পোস্টও সেটা প্রকাশ করে।

এর পর মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে এটা নিয়ে মামলা ওঠে যেটাতে পত্রিকাগুলো জুরিদের ৬-৩ ভোটে বিজয় লাভ করে। রায়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হুগো ব্ল্যাক তখন এই কথাগুলো বলেছিলেন। রোজিনা ইসলামের জামিন নামঞ্জুর, আবার শুনানি, শুনানির দুইদিন পর জামিন বিষয়ে আদেশ দেয়ার কথা বলে রোজিনাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ার পর বিচারপতি হুগো ব্ল্যাকের রায়ের এই কথাগুলো এখন ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অবরুদ্ধ। পেশাগত জীবনে সাড়া জাগানো এই মেয়েটি আজ যেমন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাঁদছে, অন্যদিকে হতবাক হয়ে অপেক্ষা করছে রোজিনার বৃদ্ধা মা ও ১১ বছরের মেয়েটি।

যে শিশুটি মায়ের অর্জনের জন্য গর্বিত, যে শিশুটি দেখে এসেছে মা মানুষের ভালোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে, মা দেশে-বিদেশে কাজের জন্য সুখ্যাতি পাচ্ছে, সেই শিশুকে কে বলবে, তার মমতাময়ী মা কাজ করতে গিয়ে ‘‘তথ্য চুরির” অভিযোগে কয়েদখানায়। সবাই ওর কাছে মায়ের এই বিপদের তথ্য গোপন করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এক রাতে মেয়েটি বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছে,‘‘বাবা আমাকে মিথ্যা বলোনা। আমি সব জেনেছি। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বলে ইউটিউবে একবার দেখে আর দেখিনি।”

একজন নারী ও নাবালিকা সন্তানের মা হিসেবে রোজিনার জামিন পাওয়াটা অধিকার। এই অধিকার কেড়ে নেয়া হলো কেন? তিনি কি তথ্য-প্রমাণাদি নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, সাক্ষীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন অথবা বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পালানোর চেষ্টা করেছেন? সবচেয়ে বড়কথা যে ধারাগুলোতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তা সবই জামিনযোগ্য। অথচ আজকে আমরা সবাই অনিশ্চয়তাপূর্ণ আশ্বাসের মুখোমুখি।

গত ২০ বছরে ভারতে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও আদালতে তা খারিজ হয়ে যায়। ভারতের মন্ত্রিসভার গোপন নথি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর শান্তনু সাইকিয়া একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়। সেই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট বলেছিল, কোন নথি ফাঁস হলে সেটাকে ”গোপন” আখ্যা দিয়ে কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অধীনে মামলা করা যায় না।

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কি জনগণের জানার অধিকার নেই? এই সব তথ্য কি গোপনীয় হিসাবে শ্রেণিভুক্ত? অবশ্যই কেউ অসৎ উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের পোপন তথ্য ব্যবহার করলে তাকে আইনের আওতায় আনার অধিকার রাষ্ট্রের আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যদি রাষ্ট্রের ক্ষতি, কোন গোষ্ঠিকে সুবিধা দেওয়া বা দুর্নীতি সংক্রান্ত হয়ে থাকে তখন আর সেটা সংরক্ষিত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে না। সেটা জনগনেণের জানার অধিকারে ভেতরে এসে পড়ে। গণমাধ্যমের খবরে দেখেছি স্বাস্থ্যখাতে মুনাফা আর লুটপাটের মহাউৎসব চলছে। কাজেই সেই তথ্যও মুক্ত তথ্য।

শুরু থেকেই রোজিনার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিহিংসার ভাব লক্ষ্য করছি। শেষপর্যন্ত প্রতিহিংসাই জয়ী হলো। তবে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, রোজিনার প্রতি প্রতিহিংসাটা কাদের বেশি? এত ক্ষোভ শুধু কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজের? প্রশাসন যন্ত্রের? নাকি অন্য কারো? এই আটক ও হেনস্তার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ক্ষোভ, বিক্ষোভ, কান্না, আবেদন, নিবেদন, আলোচনা, আইনজীবীদের যুক্তি কোনকিছুই কেন কাজে আসছে না? তাহলে কি আমরা ধরে নিবো দৃশ্যমান দাবির চেয়ে অদৃশ্য শক্তির জোর বেশি?

রোজিনাকে হেনস্তা করা প্রসঙ্গে জনগণ জানতে চায়, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে সাংবাদিক বা অন্য কোন ব্যক্তিকে সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা কি আটকে রেখে হেনস্তা করতে পারেন? আমরা জানি কোন ন্যায্য কারণ ছাড়া বাংলাদেশের কোন নাগরিককে ৫ ঘন্টা কেন, ৫ সেকেন্ডও আটকে রাখার অধিকার কারো নেই। যে নথি ফাঁস হলে দেশের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে, সেটা কিভাবে একজন প্রাইভেট সেক্রেটারির টেবিলে বিনা পাহারায় পড়ে থাকে? আর নারী ও পুরুষ মিলে রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে যেভাবে নিপীড়ন করেছে তা যৌন হয়রানির আওতায় পড়ে। এবং তা স্পষ্টতই ফৌজদারী অপরাধ।

আমরা তথ্য অধিকার আইনের কথা জানি। এই আইনের সবগুলো ধারা ২০০৯ এর ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। এদেশের নাগরিক হিসেবে আপনি সরকারের কাছে সবধরনের তথ্য জানতে চাইতে পারেন এবং সকল কর্তৃপক্ষ সেই তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। এই আইন দ্বারা সরকারের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার ৮ টি প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি ইউনিট ও সেলকে তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে ইউনিটগুলোর এই বাধ্যবাধকতা দুর্নীতি ও মানবাধিকার লংঘনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি জনগণের সেবার সাথে সম্পর্কিত। এই মন্ত্রণালয়কে কিন্তু তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি। আমরা জানতে চাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রের জন্য, এমন কি গুরুত্বপূর্ণ ও বিপদজনক তথ্য চুরি (কথিত অভিযোগ) করেছিলেন, যেটি দেশের জন্য বিপদের হতে পারে?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তথ্য অধিকার আইন দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ এর উপরেও প্রাধান্য পাবে। তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রচলিত আইনের সাথে এই আইনের বিরোধ হলে এই আইনটি প্রাধান্য পাবে। তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী, এই আইনের বিধানাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক হলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাবে। এমনকী দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ এর ক্ষেত্রেও। কাজেই দাবি জানাচ্ছি যে তথ্য অধিকার আইনের এই ধারা ও ধারা সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী সার্বিকভাবে প্রয়োগ করা হোক, যাতে দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ এর মতো পুরানো ও জনগণের জানতে চাওয়ার অধিকারের পরিপন্থী আইন অকার্যকর হয়ে পড়ে। সরকারের সব কাজ জানার অধিকার জনগণের আছে। একে রুদ্ধ করতে চাইলে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই – ‘‘স্টালিন একটা গাধা” বলে বলে মস্কোর রাস্তায় চিৎকার করছিলেন এক লোক। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। আদালত লোকটিকে ১৭ বছরের সাজা দিলেন। স্টালিনের মানহানি করায় সাজা হলো এক বছরের। বাকিটা রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ায়।
২২ মে, ২০২১
লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

Tag :

দৃশ্যমান দাবির চাইতে অদৃশ্য শক্তির জোর কি বেশি !

Update Time : ১১:২৮:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ মে ২০২১

শাহানা হুদা রঞ্জনা.

শুরু থেকেই রোজিনার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিহিংসার ভাব লক্ষ্য করছি। শেষপর্যন্ত প্রতিহিংসাই জয়ী হলো। তবে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, রোজিনার প্রতি প্রতিহিংসাটা কাদের বেশি? এত ক্ষোভ শুধু কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজের? প্রশাসন যন্ত্রের? নাকি অন্য কারো? “

‘‘যারা শাসিত হয় অর্থাৎ জনগণ, সংবাদমাধ্যম তাদের সেবার জন্য, যারা শাসন করে তাদের সেবার জন্য নয়। সংবাদমাধ্যমকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা রাষ্ট্রের গোপন তথ্য জনগনকে জানাতে পারে। শুধু মুক্ত সংবাদমাধ্যমই সরকারের প্রতারণাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে” কথাগুলো বলেছিলেন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হুগো ব্ল্যাক ১৯৭১ সালে।

এই রায়ের একটি প্রেক্ষিত আছে। আমেরিকা ও ভিয়েতনামের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি রবার্ট ম্যাকনামারা ভিয়েতনাম সংক্রান্ত সকল রাষ্ট্রীয় তথ্য, বিভিন্ন মেমো, নোট, সিদ্ধান্ত ও রিপোর্ট একত্র করে সংগ্রহ করেন। এটি ছিল একটি ৩,০০০ পাতার রিপোর্ট ও ৪,০০০ পাতার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোপনীয় দলিল। সর্বমোট ৪৭ ভলিউমের এই রিপোর্ট ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গোপনীয় দলিল যা ”পেন্টাগন পেপারস” নামে পরিচিত।

এই নথি নিয়ে কাজ করছিল ড্যানিয়েল এলসবার্গ নামে একজন অর্থনীতিবিদ, পলিসি ও সিদ্ধান্ত বিষয়ক গবেষক এবং একটিভিষ্ট। একসময় তিনি বুঝতে পারেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ আসলে ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধ নয়, এটা আমেরিকার ১৯৪৫ সাল থেকে করা পরিকল্পনার অংশ। আমেরিকা যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয় ও ক্ষতির মুখে, তখনও তারা নিয়মিত মিথ্যা বলে যাচ্ছিল জনগণের কাছে। এলসবার্গ বুঝতে পারেন ১৯৪৫ থেকে আমেরিকার সব প্রেসিডেন্ট এই মিথ্যা বলেছেন জনগণ ও সিনেটের কাছে।

এলসবার্গ ভিয়েতনাম গিয়ে দেখলেন সেখানকার প্রকৃত অবস্থা আর আমেরিকার নেতৃবৃন্দ যা বলছেন তার ভেতরে আকাশ পাতাল তফাত। তখন ভিয়েতনাম থেকে ফিরে এসে, একদিন রাতে তাই তিনি ৪৭ ভলিউমের এই গুরুত্বপূর্ণ অতি গোপনীয় দলিলের ৪০টি ভলিউম কপি করে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিকের হাতে তুলে দেন।
জুন ১৩, ১৯৭১ এর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় রাষ্ট্রের নেতৃবর্গের এই সিস্টেম্যাটিক মিথ্যার কথা প্রকাশ শুরু হয়। সাথে সাথে মার্কিন এটর্নি জেনারেল ও নিক্সন প্রশাসন আদালত থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশনা নিষিদ্ধের সমন জারিতে সক্ষম হয়। পরদিন ওয়াশিংটন পোস্টও সেটা প্রকাশ করে।

এর পর মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে এটা নিয়ে মামলা ওঠে যেটাতে পত্রিকাগুলো জুরিদের ৬-৩ ভোটে বিজয় লাভ করে। রায়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হুগো ব্ল্যাক তখন এই কথাগুলো বলেছিলেন। রোজিনা ইসলামের জামিন নামঞ্জুর, আবার শুনানি, শুনানির দুইদিন পর জামিন বিষয়ে আদেশ দেয়ার কথা বলে রোজিনাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ার পর বিচারপতি হুগো ব্ল্যাকের রায়ের এই কথাগুলো এখন ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অবরুদ্ধ। পেশাগত জীবনে সাড়া জাগানো এই মেয়েটি আজ যেমন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাঁদছে, অন্যদিকে হতবাক হয়ে অপেক্ষা করছে রোজিনার বৃদ্ধা মা ও ১১ বছরের মেয়েটি।

যে শিশুটি মায়ের অর্জনের জন্য গর্বিত, যে শিশুটি দেখে এসেছে মা মানুষের ভালোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে, মা দেশে-বিদেশে কাজের জন্য সুখ্যাতি পাচ্ছে, সেই শিশুকে কে বলবে, তার মমতাময়ী মা কাজ করতে গিয়ে ‘‘তথ্য চুরির” অভিযোগে কয়েদখানায়। সবাই ওর কাছে মায়ের এই বিপদের তথ্য গোপন করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এক রাতে মেয়েটি বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছে,‘‘বাবা আমাকে মিথ্যা বলোনা। আমি সব জেনেছি। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বলে ইউটিউবে একবার দেখে আর দেখিনি।”

একজন নারী ও নাবালিকা সন্তানের মা হিসেবে রোজিনার জামিন পাওয়াটা অধিকার। এই অধিকার কেড়ে নেয়া হলো কেন? তিনি কি তথ্য-প্রমাণাদি নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, সাক্ষীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন অথবা বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পালানোর চেষ্টা করেছেন? সবচেয়ে বড়কথা যে ধারাগুলোতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তা সবই জামিনযোগ্য। অথচ আজকে আমরা সবাই অনিশ্চয়তাপূর্ণ আশ্বাসের মুখোমুখি।

গত ২০ বছরে ভারতে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও আদালতে তা খারিজ হয়ে যায়। ভারতের মন্ত্রিসভার গোপন নথি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর শান্তনু সাইকিয়া একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়। সেই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট বলেছিল, কোন নথি ফাঁস হলে সেটাকে ”গোপন” আখ্যা দিয়ে কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অধীনে মামলা করা যায় না।

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কি জনগণের জানার অধিকার নেই? এই সব তথ্য কি গোপনীয় হিসাবে শ্রেণিভুক্ত? অবশ্যই কেউ অসৎ উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের পোপন তথ্য ব্যবহার করলে তাকে আইনের আওতায় আনার অধিকার রাষ্ট্রের আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যদি রাষ্ট্রের ক্ষতি, কোন গোষ্ঠিকে সুবিধা দেওয়া বা দুর্নীতি সংক্রান্ত হয়ে থাকে তখন আর সেটা সংরক্ষিত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে না। সেটা জনগনেণের জানার অধিকারে ভেতরে এসে পড়ে। গণমাধ্যমের খবরে দেখেছি স্বাস্থ্যখাতে মুনাফা আর লুটপাটের মহাউৎসব চলছে। কাজেই সেই তথ্যও মুক্ত তথ্য।

শুরু থেকেই রোজিনার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিহিংসার ভাব লক্ষ্য করছি। শেষপর্যন্ত প্রতিহিংসাই জয়ী হলো। তবে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, রোজিনার প্রতি প্রতিহিংসাটা কাদের বেশি? এত ক্ষোভ শুধু কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজের? প্রশাসন যন্ত্রের? নাকি অন্য কারো? এই আটক ও হেনস্তার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ক্ষোভ, বিক্ষোভ, কান্না, আবেদন, নিবেদন, আলোচনা, আইনজীবীদের যুক্তি কোনকিছুই কেন কাজে আসছে না? তাহলে কি আমরা ধরে নিবো দৃশ্যমান দাবির চেয়ে অদৃশ্য শক্তির জোর বেশি?

রোজিনাকে হেনস্তা করা প্রসঙ্গে জনগণ জানতে চায়, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে সাংবাদিক বা অন্য কোন ব্যক্তিকে সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা কি আটকে রেখে হেনস্তা করতে পারেন? আমরা জানি কোন ন্যায্য কারণ ছাড়া বাংলাদেশের কোন নাগরিককে ৫ ঘন্টা কেন, ৫ সেকেন্ডও আটকে রাখার অধিকার কারো নেই। যে নথি ফাঁস হলে দেশের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে, সেটা কিভাবে একজন প্রাইভেট সেক্রেটারির টেবিলে বিনা পাহারায় পড়ে থাকে? আর নারী ও পুরুষ মিলে রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে যেভাবে নিপীড়ন করেছে তা যৌন হয়রানির আওতায় পড়ে। এবং তা স্পষ্টতই ফৌজদারী অপরাধ।

আমরা তথ্য অধিকার আইনের কথা জানি। এই আইনের সবগুলো ধারা ২০০৯ এর ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। এদেশের নাগরিক হিসেবে আপনি সরকারের কাছে সবধরনের তথ্য জানতে চাইতে পারেন এবং সকল কর্তৃপক্ষ সেই তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। এই আইন দ্বারা সরকারের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার ৮ টি প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি ইউনিট ও সেলকে তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে ইউনিটগুলোর এই বাধ্যবাধকতা দুর্নীতি ও মানবাধিকার লংঘনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি জনগণের সেবার সাথে সম্পর্কিত। এই মন্ত্রণালয়কে কিন্তু তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি। আমরা জানতে চাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রের জন্য, এমন কি গুরুত্বপূর্ণ ও বিপদজনক তথ্য চুরি (কথিত অভিযোগ) করেছিলেন, যেটি দেশের জন্য বিপদের হতে পারে?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তথ্য অধিকার আইন দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ এর উপরেও প্রাধান্য পাবে। তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রচলিত আইনের সাথে এই আইনের বিরোধ হলে এই আইনটি প্রাধান্য পাবে। তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী, এই আইনের বিধানাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক হলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাবে। এমনকী দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ এর ক্ষেত্রেও। কাজেই দাবি জানাচ্ছি যে তথ্য অধিকার আইনের এই ধারা ও ধারা সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী সার্বিকভাবে প্রয়োগ করা হোক, যাতে দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ এর মতো পুরানো ও জনগণের জানতে চাওয়ার অধিকারের পরিপন্থী আইন অকার্যকর হয়ে পড়ে। সরকারের সব কাজ জানার অধিকার জনগণের আছে। একে রুদ্ধ করতে চাইলে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই – ‘‘স্টালিন একটা গাধা” বলে বলে মস্কোর রাস্তায় চিৎকার করছিলেন এক লোক। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। আদালত লোকটিকে ১৭ বছরের সাজা দিলেন। স্টালিনের মানহানি করায় সাজা হলো এক বছরের। বাকিটা রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ায়।
২২ মে, ২০২১
লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।