পঞ্চগড় প্রতিনিধি
বেলা গড়িয়ে হয়েছে বিকেল। সব বয়সী শিক্ষিত মানুষেরা দল বেধেঁ ছুটছেন গ্রামের পাঠাগারে। বৃদ্ধ কিংবা যুবক-যুবতী পাঠাগারটির সব বয়সী সদস্যরা আলমারী থেকে নিজেদের পছন্দ মত বই হাতে নিয়ে মজেছেন বই পড়ায়। চারিদিকে সুনশান নীরবতা, কেউ কাউকে বিরক্তও করছেনা। সবাই আপন মনে বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করেছেন। অন্যরা যখন মোবাইলে ফেসবুকিং বা গেম খেলা কিংবা অযথা বাইরে বা বাজারে অলস সময় কাটাচ্ছেন। সে সময়ে পাঠাগারিটির সদস্যরা ব্যস্ত বই পড়ায়। মাদকাসক্তি কিংবা অপরাধমুলক কোন কাজ ছুঁতে পারেনি পাঠাগারটির সদস্যদের। ভাচুর্য়াল জগত পাঠাগারটির সদস্যদের ছুঁলেও যেন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি পাঠাগারে গিয়ে বই পড়ায়। এমনকি করোনা কালেও পাঠাগারের সদস্যরা স্বাস্যবিধি মেনে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে চালিয়ে গেছেন বই পড়া। পাঠাগারটির সদস্যরা সামজিক নৈতিক অবক্ষয় রোধে সচেতনতা সৃষ্টি, যে কোন জাতীয় দিবস পালন করে খেলাধুলা থেকে সব ধরনের ক্রিয়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, সামাজিক ঝগড়া-বিবাদ মেটানো, যে কোন ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি থেকে শুরু করে সব ধরনের সমস্যার সমাধান করা হয় এই পাঠশালায়। স্ানীয় মানুষদের যেতে হয়না মেম্বার-চেয়ারম্যান এমনকি থানার কাছে। এমনি আর্দশিক কাজ করে সকলের মন জয় করে নিয়েছে পাঠাগারটি সদস্যরা। বলছি পঞ্চগড় সদর উপজেলার মীরগড় আর্দশ পাঠাগারের কথা। পুরো জেলা জুড়ে রয়েছে পাঠাগারটির সুনাম।
স্ানীয় কিছু উদ্যোগী এবং বই প্রেমী যুবকের সহায়তায় ১৯৭২ সালে ১৬ শতক জমি দান করে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন মরহুম আবুল কালাম আজাদ। প্রথমে বিভিন্ন লেখকের কিছু সংখ্যক বই নিয়ে খড়ের ঘরে ছোট একটি কক্ষে শুরু হয় পাঠাগারের কার্যক্রম। এর পরে স্ানীয়দের সহায়তা আর শ্রমের বিনিময়ে ধীরে ধীরে পূণার্ঙ্গ পাঠাগারে রুপান্তর হয়। ১৯৮৬ সালে নিবন্ধন পায় পাঠাগারটি। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৭৬৭ জন। পাঠাগারটিতে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই, গল্প, উপন্যাস, রম্য রচনা, বিজ্ঞান ভিত্তিক বই, অনুসন্ধানীমুলক বই, গবেষণা ধমর্ী বই ধমর্ীয় বই সহ মোট বইয়ের সংখ্যা ১৪’শ এর অধিক। পাঠাগারটিতে থাকা উল্লেখ যোগ্য বই গুলো হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, শিশু বিশ্বকোষ, মুসলিম কর্ীতি, পিশাচিনী সহ কুরআন-হাদীস ভিত্তিক অসংখ্য বই। পাঠাগারটির সদস্যদের প্রত্যেক্ষ এবং পরোক্ষ ভোটের মাধ্যেমে কার্য নিবার্হী কমিটির দ্বি-বার্ষিক কমিটি গঠিত হয়। মেয়াদ শেষ হলেই শুরু হয় নিবার্চন। অন্যান্য নিবার্চনের মতই চলে ভোটের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে সকল কার্যক্রম। সব বয়সী প্রাথর্ীরা নিবার্চনে প্রাথর্ী হওয়ার সুযোগও পায়। প্রচারণা, মিছিল, মিটিং সবই হয় এই পাঠাগারের নিবার্চনে। আনন্দ মুখর পরিবেশে ভোট শেষে কমিটি গঠন হয়। নিবার্চনকে ঘিরে পাঠাগারটির সদস্যদের মধ্যে যেন মিলনমেলার তৈরী হয়।
মীরগড় ময়েনউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর শিক্ষাথর্ী মাইমুনা আফরিন শান্তা বলেন, আমার বাবা-চাচারা এই পাঠাগারে এসে বই পড়তেন। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও এই পাঠাগারে এসে বই পড়ি। এখানে আমার মত ছোটদের জন্য জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য এখানে অনেক বই আছে। ডিজিটাল যুগে অন্যদের মত আমি এন্ড্রোয়েট ফোন করি। কিন্ ফোনে যে মজাটা না আমি পাই ,তার থেকে বই পড়ে বেশি মজা পাই। আমি মনে করি সকলের এই পাঠাগারে আসা উচিত।
আল মামুন রাফি নামে পাঠাগারটির কলেজ ছাত্র জানান, আমাদের বর্তমান যুব সমাজ মোবাইল ফোনে আসক্ত হলেও এই পাঠাগারটিতে যারা পড়তে আসেন তারা এ থেকে অনেকটা দূরে থাকেন। তারা এই পাঠাগারের মাধ্যেমে নিজেদের পড়ালেখা, খেলাধুলা, জ্ঞান চচার্র ধারাকে অব্যাহত রাখে। আমি সহ আমার বন্ধুরা সহ এখানে এসে বই পড়ি। একাডেমিক বইয়ের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধিকে বিকশিত করি।
পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মো রবিউল ইসলাম রবি বলেন, তৎকালীন আমি কামরুল ইসলাম, নওশেদ আলী সহ অনেক তরুণ মিলে আবুল কালামের সহযোগিতায় অল্প সংখ্যক বই নিয়ে ১৬ শতক জমির উপর পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করি। সে সময়ে বাশঁ কাঠ দিয়ে ঘর তৈরী করে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। বর্তমানে পাঠাগারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। নিত্য নতুন বইয়ের সংযোজন হয়েছে। এই পাঠাগারে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই, গল্প, উপন্যাস, রম্য রচনা, ধমর্ীয় বই সহ ১৪’শর অধিক বই আছে। আমার বয়স এখন ষাঁটের কাছাকাছি। আমরা তো আর বাইরে কোথাও আড্ডা দিতে পারিনা। তাই এই পাঠাগারে এসে বই পড়ি, সকলের সাথে সকলে কুশল বিনিময় করি। এতে করে আমাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন আরো বাড়ে। আমরা আমাদের জ্ঞানের পরিধিকে আরো বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করি।
পাঠাগারটির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক এড. মো জালাল উদ্দীন জানান, মীরগড় আদর্শ পাঠাগার একটি শুধু একটি পাঠাগারই নয় এর মাধ্যেমে এই এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, ঝগড়া-বিবাদ মেটানো, জাতীয় দিবস পালন, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ, মাহে রমজানে সেহরিতে আহ্বান, দুস্দের খাবার দেয়া সহ নানা ধরনের কাজ করে থাকে। প্রতি বছর এই পাঠাগারের সদস্যরা ২১শে ফেব্রুয়ারীতে বই মেলায় সহ সব ধরনের জাতীয় দিবসে অংশগ্রহন করে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই পাঠাগারের পরিধি এবং বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেত।