আখতারুজ্জামান তালুকদার, ক্ষেতলাল (জয়পুরহাট) প্রতিনিধিঃ
দুই হাত ছাড়াই জন্ম নেয় ২০০১ সালের ২১ জানুয়ারী জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউপির শিবপুর গ্রামের কৃষক পরিবারে অদম্য মেধাবী প্রতিবন্ধী বিউটি খাতুন (২১) । দৃঢ মনোবল নিয়ে নিজ চেষ্টা ও মা এবং বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় পা দিয়েই লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন বিউটি ছোট বেলা হতেই । পা দিয়ে লিখেই ভাল ফলাফল করে এইচএসসি পাশ করে এখন পড়াশোনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে কোনো বাঁধা নয় তা আবারও প্রমাণ করলেন বিউটি খাতুন। আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকুরী করতে চায় প্রশাসনে। সে হতে চায় বিচারক এবং দাঁড়াতে চায় তার মতো প্রতিবন্ধীদের পাশে।
জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার শিবপুর গ্রামের বিউটি খাতুন জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার দু’টি হাত থাকলেও তার আকার অত্যন্ত ছোট। এর আকার ৬ ইঞ্চি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পৃথিবীর আর সকলের মতো হাত দিয়ে নয়, বরং বিউটিকে সবকিছু করতে হয় পা দিয়েই। দুই পা কে হাত বানিয়ে করেন নিজের সব কাজ । পাশাপাশি মাকে সাহায্য করেন রান্নার কাজে। কাটেন পেঁয়াজ, মরিচ, বেগুন, আলুসহ বিভিন্ন সবজি। তার দৃঢ মনোবল ও অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণেই পা দিয়ে লিখার অভ্যাস গড়ে তোলেন মা ও বড় ভাই এর সাহায্য নিয়ে। তাদের অনুপ্রেরণায় এমন প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে পা দিয়ে লিখেই এইচএসসি পাশ করে বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছে প্রতিবন্ধী বিউটি খাতুন ।
জানা গেছে, বিউটি নিজ গ্রামের মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর স্থানীয় আকলাশ শিবপুর শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। সেখান হতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে ২০১৭ সালে এসএসসি ও বগুড়া দুপচাঁচিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ হতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪.৬৭ পেয়ে ২০১৯ সালে এইচএসসি পাস করে।
সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে কোন প্রকার কোটা সুবিধা ছাড়াই ‘ এ ‘ ইউনিটে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ৪২৭-তম হয়ে আইন বিষয়ে চ্যান্স পায়। এলএলবি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছেন এবং দীর্ঘ বন্ধের পর আগামী ১৮ অক্টোবর প্রথম বর্ষ চ’ড়ান্ত পরীক্ষা দিবে বলে জানান বিউটি।
বাবা বায়েজিদ প্রামাণিক বলেন, বিউটি যখন দু’টি হাত ছাড়াই জন্ম নিল। তখন তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। বিউটি লেখাপড়া করতে পারবে, এটা ভাবনাতেই ছিল না। শুধু চিন্তা হতো, মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে, কি হবে তার। এখন কিছুটা আশা আলো দেখতে পাই, তবে শেষ পর্যন্ত কি হবে তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত।
মা রহিমা বিবি ভোরের কাগজকে বলেন, বিউটির পড়া নিয়ে চিন্তা ছিল না তেমন। পড়তে পারলেও লেখাটাই ছিল তার প্রধান সমস্যা। তাই মেয়েকে পা দিয়ে লেখা শেখানোর চেষ্টা করি। ঘরের মেঝেতে বসিয়ে তার ডান পায়ের আঙুলের ফাঁকে কলম ধরিয়ে দিতাম। শুরুতে খুব সমস্যা হলেও কঠোর চেষ্টায় এক পর্যায়ে পা দিয়ে লেখা আয়ত্তে আনে সে। অবশ্য এক্ষেত্রে তার একমাত্র বড় ভাইও তাকে লিখতে সাহায্য করেছেন। বর্তমানে সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ছে। আরো বলেন, বিউটির ইচ্ছা শক্তি ও দৃঢ মনোবলই তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে কোনো বাঁধা নয় তার আমার মেয়ে প্রমাণ করেছে।
বিউটির বড় ভাই বগুড়া সরকারি আযিযুল কলেজ হতে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুই হাত না থাকা সেই বিউটি খাতুন পা দিয়েই করছেন নিজের প্রয়োজনীয় সব কাজ। পা দিয়ে বই ও খাতার পাতা উল্টানো, বই নেওয়া, কলম নেওয়া ও লেখা। সে ভোরের কাগজ প্রতিনিধিকে পা দিয়ে লিখে দেখান। খুব সুন্দর করেই দ্রুত গতিতে লিখছেন বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায়। এছাড়া পা দিয়েই ধারালো বটিতে কাটতে পারেন পেয়াজ, মরিচ, আলুসহ বিভিন্ন সবজি। যা দেখে বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। ভাল ফলাফল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স পাওয়ায় পেয়েছেন বেশ কিছু সন্মাননা ক্রেস্ট।
বিউটি খাতুনের কাছে তার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে চাইলে ভোরের কাগজকে জানান, আমি কারও বোঝা হতে চাইনা। ভালভাবে পড়াশোনা শেষ করে প্রশাসনে ন্যায় বিচারক হতে চাই এবং দেশের আমার মতো প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়াতে চাই।
ওই গ্রামের তার কয়েকজন সহপাঠীর সাথে ভোরের কাগজ প্রতিনিধির কথা হলে তারা জানায়, বিউটি প্রতিবন্ধী হলেও পরীক্ষায় অতিরিক্ত কোন সুযোগ-সুবিধা নেয়নি।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন জয়পুরহাট জেলা শাখার সভাপতি নুর-ই আলম দৈনিক ভোরের কাগজকে জানান, প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বিউটির মতো নারীরাই আজ আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কাজ করছেন সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন দপ্তর।
বিউটির এমন হার না মানা সাফল্য দেখে দেশের অন্য প্রতিবন্ধী নারীরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবে- এমনটাই প্রত্যাশা সুশীল ব্যক্তিদের।
ক্ষেতলাল উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাকিম মন্ডল ভোরের কাগজকে বলেন, বিউটি দুই হাত ছাড়া জন্ম নিলেও দৃঢ মনোবলের কারণে পা দিয়ে লিখেই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। আমার উপজেলার জন্য এটি অত্যন্ত গর্বের বিষয়।