শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনার ফিরে আসা; হার না মানা এক লড়াকু দেশ প্রেমিকের গল্প !

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৭:১২:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ মে ২০২২
  • ১৬৫ Time View

এফ এম শাহীন.
মে মাস মানে শেখ হাসিনার ফিরে আসার হার না মানা এক লড়াকু দেশ প্রেমিকের গল্প। জন্মদাতা ও জন্মভূমির ঋণ শোধের এক জন্মযোদ্ধার প্রত্যয় ব্যক্ত। অপরাধী খুনি অন্ধকারের অপশক্তির মনোবল ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি।

আজ থেকে ৭২ বছর আগে ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার প্রথম জন্ম হলেও ৭ ও ১৭ মে নতুনভাবে বাংলাদেশ ও বাঙালির কাছে পুনর্জীবন পেয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের ঢেলে দেয়া বুকের তাজা রক্ত ও তাঁর সঠিক নেতৃত্ব বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের দিশারি হয়ে উঠলেন তিনি। রাজপথে বাবার আন্দোলন-লড়াইয়ের জীবন আর পর্দার আড়াল থেকে বাবার সব লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকা মায়ের সংগ্রাম দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা সেই প্রথম সন্তান নিজেও বেছে নিয়েছেন পিতা-মাতার পদাঙ্ক। বাবা বঙ্গবন্ধু নিজের শিক্ষাজীবন থেকেই ছিলেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে উচ্চকণ্ঠ। সেই পথ অনুসরণ করেছেন তার প্রথম সন্তানও। আবার বঙ্গবন্ধু যেমন পরিণত বয়সে এসে দেশের মানুষের মুক্তি এনে দিয়ে পরিণত হয়েছিলেন বিশ্বরাজনীতির বলিষ্ঠ এক কণ্ঠস্বরে, ঠিক তেমনি তার প্রথম সেই সন্তানও পরিণত বয়সে এসে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তি আর উন্নয়নের লড়াইয়ের মাধ্যমে পরিণত হয়েছেন বিশ্বনেতায়। কারও কাছে শান্তির দূত, কারও কাছে বিশ্বের নেতা, কারও কাছে মানবতার নেতা হিসেবে পরিণত হওয়া তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ ১৭ মে, রবিবার ২০২০। ঘটনাক্রমে ১৯৮১ সালে ১৭ মে ছিল রবিবার। বাংলাদেশ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানুষের ভাগ্যোন্নেয়নের ইতিহাস বিনির্মাণের সূচনাক্ষণ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক ঘৃণ্য সামরিক অভ্যুত্থানে কালো রাত নেমে আসে বাঙালি জাতির জীবনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিবসহ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অবস্থানরত তাদের পরিবারের সব সদস্য ও স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা তখন পড়ালেখার জন্য পশ্চিম জার্মানিতে। তারা দু’জন ছাড়া শেখ পরিবারের বাকি সবাই সেই ১৫ আগস্ট প্রাণ হারায় ঘাতকদের হাতে।

পিতাসহ পরিবার-পরিজন হারিয়ে দুই বোন তখনো দেশে ফিরতে পারেননি। ১৯৭৫ থেকে পরের আরও পাঁচ বছর অবস্থান করেছেন ভারতে। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তেমন একটি সময়েই ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, নির্বাচিত করা হয় সভাপতি। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ওই বছরের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তিনি, শুরু করেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। আর সে কারণেই ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন তিনি। বারবার কারান্তরীণ করা হয় তাকে, হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা চালানো হয়।

রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও সেদিন ছিল ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ। কালবৈশাখীর হাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিলকে। তাদের একমাত্র আশার প্রদীপ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনাকে বরণ করতে। মুষলধারার বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলো ‘নেত্রী’ কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি। তাকে এক নজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি; বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে আমার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ তার আগমন উপলক্ষে স্বাধীনতার অমর স্লোগান ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত ছিল ঢাকার আকাশ-বাতাস। জাতির পিতার আদর্শের কর্মী ও জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- পিতৃ হত্যার বদলা নেবো’।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চরম এক প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাসিত প্রবাসী জীবন কাটাতে হয় আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার বিদেশে থাকাকালেই ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগ নেতারা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর নেতারা তার হাতে তুলে দেন দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যের সাফল্যগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পতাকা। এরপর থেকে শেখ হাসিনা দলীয় কাউন্সিলে বারবার নির্বাচিত হয়ে দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এবারসহ চারবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

ক্যালেন্ডারের ৭ মে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে একটি স্মরণীয় দিন। ২০০৭ সালের ৭ মে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারঘোষিত জরুরি অবস্থা চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা শেষে শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

সে সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন সেজন্য ক্ষমতা লোভী সেনাশাসক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে এক অবৈধ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

কিন্তু সাহসী শেখ হাসিনা তৎকালীন সরকারের বেআইনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশে ফেরার ঘোষণা দেন। অবৈধ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে শেখ হাসিনার ঐকান্তিক দৃঢ়তা, সাহস ও গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর চাপে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।

৭ মে শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে এলে লাখ লাখ জনতা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মিছিল শোভাযাত্রা সহকারে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে আসা হয়। দেশে ফিরে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় শুরু করেন নতুন সংগ্রাম।

শত বাধা-বিপত্তি-প্রতিকূলতা ও হত্যার হুমকি উপেক্ষা করেও শেখ হাসিনা ভাত-ভোট ও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারই ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর ফের আওয়ামী লীগকে এনে দিয়েছেন জয়, গঠন করেছেন সরকার। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা। বাংলাদেশ পেয়েছে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। শেখ হাসিনার অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।

মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সবসময়ই আপসহীন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক লৌহমানবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে তার সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের পর এখন পার করছেন চতুর্থ মেয়াদ। আশির দশকে যেমন তিনি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন দলকে, তেমনি একটি অনুন্নত দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যে কারণে জাতীয়-আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার আর স্বীকৃতি রয়েছে তার ঝুলিতে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম ও বিশ্বব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন উপাধি দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—

লেডি অব ঢাকা— যুক্তরাষ্ট ভিত্তিক প্রভাবশালী বিজনেস ম্যাগাজিন ‘ফোর্বস’
মাদার অব হিউম্যানিটি— ব্রিটিশ মিডিয়া
ক্যারিশম্যাটিক লিডার— মিশরের রাষ্টদূত মাহামুদ ইজ্জত
প্রাচ্যের নতুন তারকা— সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদপত্র খালিজ টাইমস
বিশ্বের নেতা— ভারতের বিজেপির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্য ড. বিনয় প্রভাকর
নারী অধিকারের স্তম্ভ— কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী মেরি ক্লড বিবেউ
বিশ্ব শান্তির দূত— কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস স্ট্যাডিস বিভাগের তিন শিক্ষক।
মানবিক বিশ্বের প্রধান নেতা— অক্সফোর্ড নেটওয়ার্ক অব পিস
জোয়ান অব আর্ক— শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান
বিশ্ব মানবতার আলোকবর্তিকা— নোবেল বিজয়ী কৈলাশ সত্যর্থী
বিশ্ব মানবতার বিবেক— কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সন্তোস
বিরল মানবতাবাদী নেতা— তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
এছাড়া তার কর্মদক্ষতা ও মহানুভবতার জন্য তিনি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে অসংখ্য পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের যে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তার কারিগর এই শেখ হাসিনা। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া একটি দেশকে যে মানুষটি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তিনি এই শেখ হাসিনাই।

কেবল স্বপ্ন দেখানোই নয়, স্বপ্নকে কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়, তার পথও দেখিয়েই চলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি। এরই মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান গোটা বিশ্বের মধ্যেই ঈর্ষণীয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্থনীতিতে বিশ্বের শীর্ষ ২৬টি দেশের মধ্যে উঠে আসবে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরাও বলছেন, বাংলাদেশ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত হতে এই দেশকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে হবে না। যার কল্যাণে এই উন্নয়ন আর উত্তরণের পথে বাংলাদেশের পথচলা, তিনি শেখ হাসিনা।

আজ সেই বঙ্গবন্ধুকন্যার ফিরে আসার দিনে প্রজন্মের প্রর্থনা শতায়ু হোন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বর্তমান প্রজন্মেরও প্রত্যাশা— পিতার অসমাপ্ত কাজ আপনাকেই সমাপ্ত করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দুর্নীতিমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাশীল আধুনিক বাংলাদেশ।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ ডট কম
সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ‘৭১

Tag :

শেখ হাসিনার ফিরে আসা; হার না মানা এক লড়াকু দেশ প্রেমিকের গল্প !

Update Time : ০৭:১২:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ মে ২০২২

এফ এম শাহীন.
মে মাস মানে শেখ হাসিনার ফিরে আসার হার না মানা এক লড়াকু দেশ প্রেমিকের গল্প। জন্মদাতা ও জন্মভূমির ঋণ শোধের এক জন্মযোদ্ধার প্রত্যয় ব্যক্ত। অপরাধী খুনি অন্ধকারের অপশক্তির মনোবল ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি।

আজ থেকে ৭২ বছর আগে ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার প্রথম জন্ম হলেও ৭ ও ১৭ মে নতুনভাবে বাংলাদেশ ও বাঙালির কাছে পুনর্জীবন পেয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের ঢেলে দেয়া বুকের তাজা রক্ত ও তাঁর সঠিক নেতৃত্ব বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের দিশারি হয়ে উঠলেন তিনি। রাজপথে বাবার আন্দোলন-লড়াইয়ের জীবন আর পর্দার আড়াল থেকে বাবার সব লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকা মায়ের সংগ্রাম দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা সেই প্রথম সন্তান নিজেও বেছে নিয়েছেন পিতা-মাতার পদাঙ্ক। বাবা বঙ্গবন্ধু নিজের শিক্ষাজীবন থেকেই ছিলেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে উচ্চকণ্ঠ। সেই পথ অনুসরণ করেছেন তার প্রথম সন্তানও। আবার বঙ্গবন্ধু যেমন পরিণত বয়সে এসে দেশের মানুষের মুক্তি এনে দিয়ে পরিণত হয়েছিলেন বিশ্বরাজনীতির বলিষ্ঠ এক কণ্ঠস্বরে, ঠিক তেমনি তার প্রথম সেই সন্তানও পরিণত বয়সে এসে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তি আর উন্নয়নের লড়াইয়ের মাধ্যমে পরিণত হয়েছেন বিশ্বনেতায়। কারও কাছে শান্তির দূত, কারও কাছে বিশ্বের নেতা, কারও কাছে মানবতার নেতা হিসেবে পরিণত হওয়া তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ ১৭ মে, রবিবার ২০২০। ঘটনাক্রমে ১৯৮১ সালে ১৭ মে ছিল রবিবার। বাংলাদেশ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানুষের ভাগ্যোন্নেয়নের ইতিহাস বিনির্মাণের সূচনাক্ষণ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক ঘৃণ্য সামরিক অভ্যুত্থানে কালো রাত নেমে আসে বাঙালি জাতির জীবনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিবসহ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অবস্থানরত তাদের পরিবারের সব সদস্য ও স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা তখন পড়ালেখার জন্য পশ্চিম জার্মানিতে। তারা দু’জন ছাড়া শেখ পরিবারের বাকি সবাই সেই ১৫ আগস্ট প্রাণ হারায় ঘাতকদের হাতে।

পিতাসহ পরিবার-পরিজন হারিয়ে দুই বোন তখনো দেশে ফিরতে পারেননি। ১৯৭৫ থেকে পরের আরও পাঁচ বছর অবস্থান করেছেন ভারতে। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তেমন একটি সময়েই ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, নির্বাচিত করা হয় সভাপতি। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ওই বছরের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তিনি, শুরু করেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। আর সে কারণেই ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন তিনি। বারবার কারান্তরীণ করা হয় তাকে, হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা চালানো হয়।

রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও সেদিন ছিল ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ। কালবৈশাখীর হাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিলকে। তাদের একমাত্র আশার প্রদীপ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনাকে বরণ করতে। মুষলধারার বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলো ‘নেত্রী’ কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি। তাকে এক নজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি; বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে আমার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ তার আগমন উপলক্ষে স্বাধীনতার অমর স্লোগান ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত ছিল ঢাকার আকাশ-বাতাস। জাতির পিতার আদর্শের কর্মী ও জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- পিতৃ হত্যার বদলা নেবো’।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চরম এক প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাসিত প্রবাসী জীবন কাটাতে হয় আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার বিদেশে থাকাকালেই ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগ নেতারা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর নেতারা তার হাতে তুলে দেন দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যের সাফল্যগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পতাকা। এরপর থেকে শেখ হাসিনা দলীয় কাউন্সিলে বারবার নির্বাচিত হয়ে দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এবারসহ চারবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

ক্যালেন্ডারের ৭ মে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে একটি স্মরণীয় দিন। ২০০৭ সালের ৭ মে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারঘোষিত জরুরি অবস্থা চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা শেষে শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

সে সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন সেজন্য ক্ষমতা লোভী সেনাশাসক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে এক অবৈধ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

কিন্তু সাহসী শেখ হাসিনা তৎকালীন সরকারের বেআইনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশে ফেরার ঘোষণা দেন। অবৈধ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে শেখ হাসিনার ঐকান্তিক দৃঢ়তা, সাহস ও গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর চাপে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।

৭ মে শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে এলে লাখ লাখ জনতা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মিছিল শোভাযাত্রা সহকারে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে আসা হয়। দেশে ফিরে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় শুরু করেন নতুন সংগ্রাম।

শত বাধা-বিপত্তি-প্রতিকূলতা ও হত্যার হুমকি উপেক্ষা করেও শেখ হাসিনা ভাত-ভোট ও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারই ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর ফের আওয়ামী লীগকে এনে দিয়েছেন জয়, গঠন করেছেন সরকার। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা। বাংলাদেশ পেয়েছে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। শেখ হাসিনার অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।

মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সবসময়ই আপসহীন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক লৌহমানবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে তার সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের পর এখন পার করছেন চতুর্থ মেয়াদ। আশির দশকে যেমন তিনি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন দলকে, তেমনি একটি অনুন্নত দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যে কারণে জাতীয়-আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার আর স্বীকৃতি রয়েছে তার ঝুলিতে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম ও বিশ্বব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন উপাধি দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—

লেডি অব ঢাকা— যুক্তরাষ্ট ভিত্তিক প্রভাবশালী বিজনেস ম্যাগাজিন ‘ফোর্বস’
মাদার অব হিউম্যানিটি— ব্রিটিশ মিডিয়া
ক্যারিশম্যাটিক লিডার— মিশরের রাষ্টদূত মাহামুদ ইজ্জত
প্রাচ্যের নতুন তারকা— সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদপত্র খালিজ টাইমস
বিশ্বের নেতা— ভারতের বিজেপির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্য ড. বিনয় প্রভাকর
নারী অধিকারের স্তম্ভ— কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী মেরি ক্লড বিবেউ
বিশ্ব শান্তির দূত— কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস স্ট্যাডিস বিভাগের তিন শিক্ষক।
মানবিক বিশ্বের প্রধান নেতা— অক্সফোর্ড নেটওয়ার্ক অব পিস
জোয়ান অব আর্ক— শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান
বিশ্ব মানবতার আলোকবর্তিকা— নোবেল বিজয়ী কৈলাশ সত্যর্থী
বিশ্ব মানবতার বিবেক— কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সন্তোস
বিরল মানবতাবাদী নেতা— তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
এছাড়া তার কর্মদক্ষতা ও মহানুভবতার জন্য তিনি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে অসংখ্য পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের যে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তার কারিগর এই শেখ হাসিনা। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া একটি দেশকে যে মানুষটি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তিনি এই শেখ হাসিনাই।

কেবল স্বপ্ন দেখানোই নয়, স্বপ্নকে কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়, তার পথও দেখিয়েই চলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি। এরই মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান গোটা বিশ্বের মধ্যেই ঈর্ষণীয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্থনীতিতে বিশ্বের শীর্ষ ২৬টি দেশের মধ্যে উঠে আসবে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরাও বলছেন, বাংলাদেশ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত হতে এই দেশকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে হবে না। যার কল্যাণে এই উন্নয়ন আর উত্তরণের পথে বাংলাদেশের পথচলা, তিনি শেখ হাসিনা।

আজ সেই বঙ্গবন্ধুকন্যার ফিরে আসার দিনে প্রজন্মের প্রর্থনা শতায়ু হোন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বর্তমান প্রজন্মেরও প্রত্যাশা— পিতার অসমাপ্ত কাজ আপনাকেই সমাপ্ত করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দুর্নীতিমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাশীল আধুনিক বাংলাদেশ।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ ডট কম
সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ‘৭১