বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

অগ্নিরোধে বিশ্বমানের “বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি”

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৮:৩৪:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ জুন ২০২২
  • ১৪৮ Time View

বনলতা ডেস্ক. পৃথিবীর সব দেশেই চলছে ভয়াবহ সব অগ্নিদুর্ঘটনা । অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ দাবানল দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। অগ্নিনির্বাপণে হিমশিম খেতে হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ দেশগুলোকেও।

যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলোতে দাবানল ক্রমেই বাড়ছে। সেই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের বহির্বিশ্বের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ঘটছে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে গত শনিবার রাতে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনার পর জরুরি আলোচনার বিষয় হয়ে পড়েছে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা।

দেশে অর্থনীতির দ্রুত সম্প্রসারণ আর শিল্পায়নের বাড়ার ফলে সারা দেশে অগ্নিদুর্ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এসব দুর্ঘটনা মোকাবিলাসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে উদ্ধারকাজ পরিচালনায় আরও আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম প্রয়োজন। এজন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে অত্যাধুনিক করে গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা বাড়াতে ফায়ার সার্ভিসের বহরে অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি যুক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন। পাশাপাশি বহুতল ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ নিশ্চিত করতে বলেছেন। অগ্নিদুর্ঘটনাসহ সার্বিক নিরাপত্তায় সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি ও নজরদারির ওপরও জোর দিতে বলেছেন।

বনানীর অগ্নিদুর্ঘটনা, চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনাসহ সাম্প্রতিক নানা দুর্ঘটনায় সড়কের যানজট, উৎসাহী জনতার ভিড় এবং সংকুচিত হয়ে যাওয়া প্রবেশপথে অগ্নিনির্বাপক দলের বিলম্বে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর বিষয়টিও ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। একই সঙ্গে এসেছে অকুতোভয় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষের সাহসিকতা ও ত্যাগের মানবিক দৃষ্টান্তের কথাও। তবে আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক প্রযুক্তির অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম ছাড়া প্রশিক্ষিত বাহিনী দিয়েও যথাযথ উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভব নয়।

বিগত বছরগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের সেবা বিস্তার এবং আরও আধুনিকায়ন করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকায় ১১টি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপনে প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তাছাড়া রাজধানীর বহুতল ভবনসমূহের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার তদারকিতে ডিজিটাল ডেটাবেইজ তৈরিতে দক্ষিণ কোরিয়া অর্থায়নে প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়। ভবনসমূহের মধ্যে কোনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং কোনগুলোর বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি তা নির্ধারণ আর সেই লক্ষ্যে কাজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর জন্য উঁচু মই বা ফায়ার ল্যাডারসহ ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন জরুরি তেমনি প্রতিটি ভবনের নিজস্ব হাইড্রেন্ট বা জলাধার, ফায়ার এক্সিট বা জরুরি নির্গমন পথ এবং তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য প্রতিটি ভবনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিটি বহুতল ভবন, কল-কারখানায়, নগর-শহর-বন্দরের নাগরিকদের অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলার প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের তত্ত্বাবধানে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্মকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি সময়োপযোগী আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

অগ্নিনিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থার আরও আধুনিকায়ন ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে দেশে প্রথমবারের ‘বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি’ স্থাপন হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায়। যেখানে অফিসার ও ফায়ারম্যানের বেসিক ও অ্যাডভান্স কোর্স সম্পন্ন হবে। এ ছাড়াও এই একাডেমিতে গড়ে তোলা হবে বিশ্বমানের ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই শুরু হবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কার্যক্রম। ১০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হবে ফায়ার একাডেমি। আগামী বছরেই ফায়ার একাডেমিতে চালু হবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা (পিজিডি)। এ ছাড়াও এখানে ‘মাস্টার্স ইন ফায়ার সায়েন্স’ কোর্সও চালুর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে এই কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি হবে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে। এখানে প্রতিষ্ঠা করা হবে ‘ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব’। যা থেকে অগ্নিকাণ্ডের পর সেখানকার ছাই বা আলামত পরীক্ষার মাধ্যমে আগুন লাগার সঠিক কারণ জানা যাবে। এখন পর্যন্ত দেশে এই অত্যাধুনিক ব্যবস্থাটি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। এই কারণে দাম বেশি। দেশে উৎপাদন করা গেলে দাম কম হতো। তাহলে মানুষ ভবনে ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম ব্যবহারে উৎসাহিত হতো বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম যদি কম মূল্যে পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকেরা এগুলো সহজে বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। বাংলাদেশে যদি তৈরি হয়, তাহলে সবাই সহজে পাবে। বাংলাদেশে ফায়ার নির্বাপণ সরঞ্জামের কোনো কারখানা নেই।

গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর যে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। ঘটনা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার কারণ হচ্ছে সেখানে অনেক ধরনের রাসায়নিক ছিল। সাধারণত এ ধরনের ডিপোতে ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার থাকে। এর মধ্যে বিষাক্ত, দাহ্য বা বিস্ফোরণ ঝুঁকিসম্পন্ন রাসায়নিক থাকে। আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর বিস্ফোরণের ফলে সেটা একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই ঘটনা দেশের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থায় একটা বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন অনেকে। প্রাথমিক অবস্থায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এত বড় দুর্ঘটনা দেখতে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনটেইনারগুলোতে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সাধারণ অবস্থায় দাহ্য নয়। এটা অক্সিডাইজিং বা অগ্নিসহায়ক রাসায়নিক হিসেবে কাজ করে। কোথাও এই রাসায়নিক উপদান থাকলে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। বিস্ফোরণের অবস্থায় পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় দরকার হয়। অথচ ডিপোতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলে ওই সময়ের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে জরুরি যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো একেবারেই করা হয়নি। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত আটজন কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। মূলত তারা কোনো কিছু চিন্তা না করেই আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অথচ সেটা সাধারণ অগ্নিকাণ্ড ছিল না। রাসায়নিকের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা প্রস্তুতি দরকার ছিল। সেখানকার শ্রমিক ও অন্যদের যেভাবে বের করে আনা দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। সেখানে উৎসুক জনতা ভিড় করেছে, ছবি তুলেছে, ভিডিও করেছে, ডিপোর কর্মচারীরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। এ কারণে এত হতাহত হয়েছে। ডিপোতে যদি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকত, তাহলে শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যেত।

এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকপূর্ণ কনটেইনার একটার পর একটা যেভাবে রাখা হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কনটেইনার রাখার একটা আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। আলাদা জায়গায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার রাখতে হবে। অন্যান্য পণ্যবাহী কনটেইনার থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে বিপজ্জনক পণ্য ও রাসায়নিক রাখার জন্য আলাদা শেড আছে। সীতাকুণ্ডের ডিপোটাতে এটা মেনে চললে ফায়ার সার্ভিস আগুনটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখতে পারত, ছড়িয়ে পড়ত না। লেবাননের বৈরুতের মতো রাসায়নিক থাকলে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। সে ক্ষেত্রে আরও বড় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারতো। সীতাকুণ্ডের এ দুর্ঘটনা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। বেসরকারি ডিপোগুলো সেটা মেনে চলছে কি না, তা তদারকির কর্তৃপক্ষ কে, সেটা এখন অনেক বড় প্রশ্ন।

পুরান ঢাকার নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো বড় দুর্ঘটনা লোকালয়ের মধ্যে অবৈধভাবে রাসায়নিক মজুত করার কারণেই হয়েছে। সর্বশেষ সীতাকুণ্ডের ঘটনার মধ্যেও সাধারণ ভুল আর পদক্ষেপই ছিল। ভয়াবহ এসব অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিতে বাধ্য হবে। কারখানা ও বন্দরগুলোতে পরিদর্শন বাড়ানো হবে। তবে সবার ওপরে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের পাশাপাশি বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ ও দ্ক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। সুত্র- দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা.

Tag :

অগ্নিরোধে বিশ্বমানের “বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি”

Update Time : ০৮:৩৪:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ জুন ২০২২

বনলতা ডেস্ক. পৃথিবীর সব দেশেই চলছে ভয়াবহ সব অগ্নিদুর্ঘটনা । অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ দাবানল দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। অগ্নিনির্বাপণে হিমশিম খেতে হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ দেশগুলোকেও।

যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলোতে দাবানল ক্রমেই বাড়ছে। সেই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের বহির্বিশ্বের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ঘটছে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে গত শনিবার রাতে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনার পর জরুরি আলোচনার বিষয় হয়ে পড়েছে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা।

দেশে অর্থনীতির দ্রুত সম্প্রসারণ আর শিল্পায়নের বাড়ার ফলে সারা দেশে অগ্নিদুর্ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এসব দুর্ঘটনা মোকাবিলাসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে উদ্ধারকাজ পরিচালনায় আরও আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম প্রয়োজন। এজন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে অত্যাধুনিক করে গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা বাড়াতে ফায়ার সার্ভিসের বহরে অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি যুক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন। পাশাপাশি বহুতল ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ নিশ্চিত করতে বলেছেন। অগ্নিদুর্ঘটনাসহ সার্বিক নিরাপত্তায় সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি ও নজরদারির ওপরও জোর দিতে বলেছেন।

বনানীর অগ্নিদুর্ঘটনা, চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনাসহ সাম্প্রতিক নানা দুর্ঘটনায় সড়কের যানজট, উৎসাহী জনতার ভিড় এবং সংকুচিত হয়ে যাওয়া প্রবেশপথে অগ্নিনির্বাপক দলের বিলম্বে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর বিষয়টিও ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। একই সঙ্গে এসেছে অকুতোভয় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষের সাহসিকতা ও ত্যাগের মানবিক দৃষ্টান্তের কথাও। তবে আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক প্রযুক্তির অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম ছাড়া প্রশিক্ষিত বাহিনী দিয়েও যথাযথ উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভব নয়।

বিগত বছরগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের সেবা বিস্তার এবং আরও আধুনিকায়ন করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকায় ১১টি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপনে প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তাছাড়া রাজধানীর বহুতল ভবনসমূহের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার তদারকিতে ডিজিটাল ডেটাবেইজ তৈরিতে দক্ষিণ কোরিয়া অর্থায়নে প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়। ভবনসমূহের মধ্যে কোনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং কোনগুলোর বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি তা নির্ধারণ আর সেই লক্ষ্যে কাজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর জন্য উঁচু মই বা ফায়ার ল্যাডারসহ ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন জরুরি তেমনি প্রতিটি ভবনের নিজস্ব হাইড্রেন্ট বা জলাধার, ফায়ার এক্সিট বা জরুরি নির্গমন পথ এবং তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য প্রতিটি ভবনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিটি বহুতল ভবন, কল-কারখানায়, নগর-শহর-বন্দরের নাগরিকদের অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলার প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের তত্ত্বাবধানে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্মকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি সময়োপযোগী আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

অগ্নিনিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থার আরও আধুনিকায়ন ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে দেশে প্রথমবারের ‘বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি’ স্থাপন হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায়। যেখানে অফিসার ও ফায়ারম্যানের বেসিক ও অ্যাডভান্স কোর্স সম্পন্ন হবে। এ ছাড়াও এই একাডেমিতে গড়ে তোলা হবে বিশ্বমানের ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই শুরু হবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কার্যক্রম। ১০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হবে ফায়ার একাডেমি। আগামী বছরেই ফায়ার একাডেমিতে চালু হবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা (পিজিডি)। এ ছাড়াও এখানে ‘মাস্টার্স ইন ফায়ার সায়েন্স’ কোর্সও চালুর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে এই কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি হবে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে। এখানে প্রতিষ্ঠা করা হবে ‘ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব’। যা থেকে অগ্নিকাণ্ডের পর সেখানকার ছাই বা আলামত পরীক্ষার মাধ্যমে আগুন লাগার সঠিক কারণ জানা যাবে। এখন পর্যন্ত দেশে এই অত্যাধুনিক ব্যবস্থাটি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। এই কারণে দাম বেশি। দেশে উৎপাদন করা গেলে দাম কম হতো। তাহলে মানুষ ভবনে ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম ব্যবহারে উৎসাহিত হতো বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম যদি কম মূল্যে পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকেরা এগুলো সহজে বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। বাংলাদেশে যদি তৈরি হয়, তাহলে সবাই সহজে পাবে। বাংলাদেশে ফায়ার নির্বাপণ সরঞ্জামের কোনো কারখানা নেই।

গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর যে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। ঘটনা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার কারণ হচ্ছে সেখানে অনেক ধরনের রাসায়নিক ছিল। সাধারণত এ ধরনের ডিপোতে ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার থাকে। এর মধ্যে বিষাক্ত, দাহ্য বা বিস্ফোরণ ঝুঁকিসম্পন্ন রাসায়নিক থাকে। আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর বিস্ফোরণের ফলে সেটা একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই ঘটনা দেশের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থায় একটা বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন অনেকে। প্রাথমিক অবস্থায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এত বড় দুর্ঘটনা দেখতে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনটেইনারগুলোতে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সাধারণ অবস্থায় দাহ্য নয়। এটা অক্সিডাইজিং বা অগ্নিসহায়ক রাসায়নিক হিসেবে কাজ করে। কোথাও এই রাসায়নিক উপদান থাকলে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। বিস্ফোরণের অবস্থায় পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় দরকার হয়। অথচ ডিপোতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলে ওই সময়ের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে জরুরি যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো একেবারেই করা হয়নি। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত আটজন কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। মূলত তারা কোনো কিছু চিন্তা না করেই আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অথচ সেটা সাধারণ অগ্নিকাণ্ড ছিল না। রাসায়নিকের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা প্রস্তুতি দরকার ছিল। সেখানকার শ্রমিক ও অন্যদের যেভাবে বের করে আনা দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। সেখানে উৎসুক জনতা ভিড় করেছে, ছবি তুলেছে, ভিডিও করেছে, ডিপোর কর্মচারীরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। এ কারণে এত হতাহত হয়েছে। ডিপোতে যদি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকত, তাহলে শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যেত।

এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকপূর্ণ কনটেইনার একটার পর একটা যেভাবে রাখা হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কনটেইনার রাখার একটা আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। আলাদা জায়গায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার রাখতে হবে। অন্যান্য পণ্যবাহী কনটেইনার থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে বিপজ্জনক পণ্য ও রাসায়নিক রাখার জন্য আলাদা শেড আছে। সীতাকুণ্ডের ডিপোটাতে এটা মেনে চললে ফায়ার সার্ভিস আগুনটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখতে পারত, ছড়িয়ে পড়ত না। লেবাননের বৈরুতের মতো রাসায়নিক থাকলে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। সে ক্ষেত্রে আরও বড় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারতো। সীতাকুণ্ডের এ দুর্ঘটনা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। বেসরকারি ডিপোগুলো সেটা মেনে চলছে কি না, তা তদারকির কর্তৃপক্ষ কে, সেটা এখন অনেক বড় প্রশ্ন।

পুরান ঢাকার নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো বড় দুর্ঘটনা লোকালয়ের মধ্যে অবৈধভাবে রাসায়নিক মজুত করার কারণেই হয়েছে। সর্বশেষ সীতাকুণ্ডের ঘটনার মধ্যেও সাধারণ ভুল আর পদক্ষেপই ছিল। ভয়াবহ এসব অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিতে বাধ্য হবে। কারখানা ও বন্দরগুলোতে পরিদর্শন বাড়ানো হবে। তবে সবার ওপরে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের পাশাপাশি বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ ও দ্ক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। সুত্র- দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা.