গুরুদাসপুর প্রতিনিধি.হাজেরা বেগম (৭৪)। একজন সংগ্রামী মা। তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন তার বড় পরিচয় তিনি একজন সফল রত্নাগর্ভা মা । ৯জন মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপুর্ন পদে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নারায়নপুর গ্রামের মৃত স্কুল শিক্ষক আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী তিনি।
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত ৯ সন্তানের এই জননী অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। প্রতিটি সন্তানকে সুশিক্ষায় গড়ে তুলেছেন।তাঁরা এখন স্বমহিমায় দেশের সেবা করে যাচ্ছেন। আপন আলোয় উদ্ভাসিত এই মা তার দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস ও সততার কারণে বড়াইগ্রাম উপজেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময় নানা সম্মাননায় ভুষিত হয়েছেন।
হাজেরা বেগমের ৯ জন মেয়ে। প্রথম মেয়ে ড. সাইদা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক , দ্বিতীয় মেয়ে সিদ্দিকা আকতার, উচ্চ শিক্ষিতা, তৃতীয় মেয়ে মিনু আকতার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, চতুর্থ মেয়ে শাহীনা আকতার রিনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, পঞ্চম মেয়ে শামীমা আকতার বিন্দু, কলেজ শিক্ষিকা, ষষ্ট মেয়ে ছাবিহা আকতার মুন্নি, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সপ্তম মেয়ে ডঃ সুমনা আকতার সুমি বরেন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক, অষ্টম মেয়ে সামিরা আকতার সুইট, লে. কর্নেল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নবম মেয়ে ডা.স্নিগদ্ধা আকতার ছন্দা, মেডিকেল অফিসার গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়াও ৯জন মেয়েকে বিবাহ দিয়েছেন উচ্চ শিক্ষিত সু-প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে।
হাজেরা বেগম বলেন,‘১৯৬০ সালে অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর ১৪ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নারায়নপুর গ্রামের মৃত-আব্দুস সাত্তার সরকারের সাথে বিয়ে হয়েছিলো। ৭০ এর দশক থেকে ২০০০ পর্যন্ত এই অঞ্চলে তার স্বামী ছিলেন একজন স্বনাম ধন্য স্কুল শিক্ষক। একটা পুত্র সন্তানের আশায় পর পর ৯ জন কন্যার সন্তানের মা হয়েছিলাম। আমার স্বপ্ন ছিলো আমার প্রতিটি মেয়েই উচ্চ শিক্ষিত হয়ে রাষ্ট্রের বড় পদে আসিন হবে। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য মেয়েদেরকে স্কুল কলেজ কৃতিত্বের সাথে পার করিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের জন্য প্রত্যেক মেয়েকে সুযোগ করে দিয়েছিলাম। সে স্বপ্নটা অধরা থাকলেও এই ৯জন মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমি এবং আমার স্বামী প্রতি মুহুর্তে হাড়ভাঙ্গা কষ্ট করেছি। তবে আশার কথা হলো আমার মেয়েরা লেখাপড়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ দ্বিতীয় হয়নি। প্রতিটি মেয়েই প্রতিটি জায়গায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এখন বাকী জীবনটা নাতী-নাতনীদের নিয়ে কাটিয়ে দিতে চাই।’
হাজেরা বেগমের মেয়ে লে. কর্নেল সামিরা আকতার সুইট বলেন,‘আমার মা একজন আদর্শ মা। যার অনুপ্রেরণায় আজ আমরা ৯ কোন এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। বাবা ২০০৯ সালে মৃত্যু বরণ করেন। তারপর থেকে মা একা হয়ে যান। চাকুরির সুবাদে আমাকে মিশনে যেতে হয়। তখন আমার শিশু বাচ্চাকে মায়ের কাছে রেখে যেতে হয়েছে। শুধু পড়াশোনা করিয়েই শেষ হয়নি আমার মায়ের দায়িত্ব। এখন পর্যন্ত আমার মা আমাদের পাশে সার্বক্ষণিক ভাবে সহযোগিতা করে আসছে। বাবা আর্থিক জোগান দিয়ে আমাদের লেখাপড়া চালিয়েছে। আর মা আমাদের প্রতিটি সময় সাহস জুগিয়েছে কিভাবে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সু-প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করতে হবে। আমার বাবা মাকে নিয়ে আমি গর্বিত। কারন আমি একজন আদর্শ মায়ের আদর্শ সন্তান।’
ছোট মেয়ে ডা.স্নিগদ্ধা আকতার ছন্দা বলেন,‘ আমি আমার বাবা মায়ের ছোট মেয়ে। বর্তমানে আমি গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসাবে কর্মরত আছি। বাবা মা’র পাশাপাশি আমার বড় বোনরা আমাকে ব্যপকভাবে সহযোগিতা করেছে। পাশাপাশি আমার স্বামী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি এস এম শহিদুল ইসলাম সোহেল বিয়ের পর থেকে আমাকে আমার স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করেছে। ছোট বেলা থেকেই আমার মায়ের স্বপ্ন ছিলো আমাকে ডাক্তার হিসাবে দেখার। আজ তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’