শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মফস্বলে ভালো সাংবাদিকতা

বেশ কিছুদিন আগের কথা। কুমিল্লার এক সংবাদকর্মীর ফোনে ঘুম ভাঙলো। ফোন ধরতেই বললেন,
– ভাই, একটা নিউজ আছে, পাঠাবো? বললাম,
– কী নিউজ’? ব্যস্ত হয়ে বললেন,
– এমপি স্যারের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে আছি। ছবি আর নিউজ পাঠাচ্ছি। চরম বিরক্ত লাগলো। বললাম,
– স্যারের নিউজের গুরুত্ব কী’? বললেন,
– বিজ্ঞাপন আসবে ভাই’। বললাম,
– কয়টা নিউজের বিনিময়ে কয়টা বিজ্ঞাপন? ওপাশ থেকে বিব্রত হয়ে বললেন, – আগে নিউজগুলো প্রকাশ হোক তারপর ধরবো ভাই’। বললাম,
– আগে কি স্যার কোনো বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে সংবাদকর্মী বললেন,
– আগে নিউজ দিতে হবে ভাই, তাহলে বিজ্ঞাপন আসবে’।
২.
বছর খানেক আগের কথা। উত্তরাঞ্চলের এক জেলার একজন প্রভাবশালীর অনিয়ম নিয়ে নিউজ প্রকাশ হলো। তিনি হুমকি দিলেন- মামলা করবেন, প্রতিনিধিকেও দেখে নেবেন। সহকর্মী ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন,
– কী করা যায়? বললাম,
– ঐ ব্যক্তির বিষয়ে বর্তমান আর অতীতের আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করেন। সেগুলো বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন।
বেশ কিছুদিন পর জানা গেল ঐ প্রভাবশালী নীরব হয়ে গেছেন। মামলা দূরে থাক, বরং প্রতিনিধির সঙ্গে আপোষ করতে চান। এমনকি বিজ্ঞাপন দিয়ে সহায়তাও করতে চান।
উপরের দুটি ঘটনা শুধু মফস্বলেরই নয়, সাংবাদিকতার জাতীয় চিত্রও বটে। সংবাদকর্মীরা অর্থ আর ক্ষমতার প্রভাবে হয় প্রভাবিত হন কিংবা প্রভাবিত করেন। যখন কোনো গণমাধ্যম প্রভাবিত হয়, তখন ভালো সাংবাদিকতা না-ও হতে পারে। তবে যখন প্রভাবিত করার বিষয় আসে তখন ভালো সাংবাদিকতা ছাড়া তা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, ভালো সাংবাদিকতার শক্তির উৎস কী? কারা ভালো সাংবাদিকতার পথ তৈরি করতে পারেন?
৩.
গণমাধ্যমের এই দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কিছু বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। সেটা হলো, বর্তমানে সাংবাদিকতাকে আমরা নানাভাবে বিশেষায়িত করছি। যেমন ভালো সাংবাদিকতার সমার্থক হিসেবে সাহসী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কথা বলছি। কখনও জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার সঙ্গে মফস্বল সাংবাদিকতার দূরত্ব তৈরি করছি। অর্থাৎ সাংবাদিকতার গুণগত মানের বিচার করতে গিয়ে এমন তুলনামূলক শব্দগুলো প্রয়োগ করছি।
ঘটনা অনেকটা ‘জোর করে ধর্ষণ’ ধারণার মতো। এখানে ‘ধর্ষণ’ শব্দের সঙ্গে অতিরিক্ত ‘জোর’ জুড়িয়ে দিয়ে অতিশয় করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ কিংবা সাহসী শব্দ যুক্ত করে অতিরিক্ত বিশেষায়িত করা হচ্ছে। আমরা জাতীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করতে গিয়ে মফস্বল বা স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতাকে কম গুরুত্ব দিচ্ছি। টিকে থাকার জন্য বড় আয়ের উৎস হিসেবে রাজধানীকে সাংবাদিকতার লক্ষ্য করে নিয়েছি।
এর প্রধান কারণ সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য আর কাঠামো কয়েক দশকে অনেকটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। দেশে ক্ষমতামুখী রাজনীতি আর পুঁজির দাপট গণমাধ্যমের প্রচলিত নীতিবোধকে কোনঠাসা করেছে। গণমাধ্যম যেমন বিনিয়োগকারীদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, তেমনি সংবাদকর্মীরাও অজান্তেই প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক সময় বিজ্ঞাপনের চাপ প্রভাবিত হতে বাধ্য করছে। আর এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেজন্যই সাহসী, বস্তুনিষ্ঠ বিশেষণগুলো সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বেশি করে।
৪.
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো কিংবা উন্নয়নকর্মযজ্ঞে মগ্ন দেশগুলোর ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে স্বচ্ছতায় নিয়ে আসতে পারে। যাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পদ্ধতিগত অপচয় বা আত্মসাতের মাত্রা অনেকটা কমে আসবে। তৈরি হবে জবাবদিহিতা, সমাজে ফিরবে শৃঙ্খলা।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মতপ্রকাশ তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয় রাজনৈতিক আর ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে। যে কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দেয়। যা চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। দেশে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার চেয়ে মফস্বল সাংবাদিকতার গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ, কেন্দ্রীভুত উন্নয়ন সুষম উন্নয়নের পরিপন্থি। যে কারণে সুষম উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয়া স্থানীয় সরকারের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে মফস্বল সাংবাদিকতা।
নব্বই দশকে স্বৈরাচার পতনের পর সারাদেশে জেলা-উপজেলায় অসংখ্য স্থানীয় পত্রিকার জন্ম হয়। যা স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন, সুরাজনীতি, সুশিক্ষা, সুসংস্কৃতির বিকাশে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। একই সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিতও করতে থাকে। তবে এক পর্যায়ে ভালো সাংবাদিকতা, পরিকল্পনা, বিজ্ঞাপন আর বিনিয়োগ সংকটে পত্রিকাগুলো অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
৫.
এমন একটা বৈরী সময়েই তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতির হাত ধরে কয়েক বছরে স্থানীয় পর্যায়ে ইন্টারনেটভিত্তিক যে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো যাত্রা শুরু করেছে সেগুলো নতুন করে সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চাইলে ভালো উদ্যোগ আর পরিকল্পনায় ভালো সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনপ্রিয় আর প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে এসব পোর্টাল। যেখানে টেকসই বিজনেস মডেল তৈরি হতে পারে। হতে পারে সাংবাদিকতার ভিন্ন ধারাও।
এক্ষেত্রে ভালো সাংবাদিকতার পথ আর শক্তির উৎস বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। প্রশ্ন অনেক জটিল হলেও পথ একটাই, গণমাধ্যমকে লাভজনক করতে হবে। বিনিয়োগ করা অর্থ যদি ফেরৎ আসে তাহলে সাহসী ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা অগ্রসর হবেন। ঠিক তখনই ভালো কিংবা সাহসী সাংবাদিকতার পথ তৈরি হবে। বলতে গেলে, এটা দারিদ্রের দুষ্টুচক্রের মতোই ব্যাপার। গণমাধ্যমকে জনপ্রিয় করতে না পারলে বিজ্ঞাপনের আয় পাবেন না; বিজ্ঞাপনের আয় না পেলে গণমাধ্যম লাভজনক হবে না; আর লাভজনক না হলে ভালো সাংবাদিকতা হবে না; আর ভালো সাংবাদিকতা না থাকলে গণমাধ্যম জনপ্রিয় হবে না।
৬.
তাই গণমাধ্যমকে জনপ্রিয় আর লাভজনক করতে হলে ভালো সাংবাদিকতা করার ঝুঁকি নিতেই হবে। এজন্য আগে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব পরিহার করতে হবে। আবেগ কিংবা বিশ্বাসের ওপর ভর করা কোনো নৈতিকতা থেকেও বেরুতে হবে। বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী, মহল বা ধর্মের স্বার্থে নয়, গণমাধ্যমকে হতে হবে সাংবিধানিক আইন, সুশাসন আর গণতন্ত্রের পক্ষে। রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে হবে। তাহলেই গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা বাড়বে। জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে টেকসই বিজনেস মডেল বাস্তবায়ন সহজ হয়ে উঠবে।
লক্ষ্যে অটল থেকে সাহসী এই সাংবাদিকতা শুরু করা যেতে পারে মফস্বল থেকেই। সেটা পত্রিকা কিংবা অনলাইন উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক নতুন ধারার যে অনলাইন সাংবাদিকতা, সেখানে সাহসী প্রতিবেদনই কিন্তু সব নয়। কোনো পোর্টালকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য জনপ্রিয় ও গুণগত মানের কনটেন্ট তৈরিও করতে হবে। যার জন্য সঠিক পরিকল্পনা থাকা দরকার। কেননা, দিন শেষে ভালো আর জনপ্রিয় কনটেন্টই ভালো বিজনেস মডেল বাস্তবায়নে সহায়ক হয়।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আনন্দবাজার
Tag :
About Author Information

Daily Banalata

মফস্বলে ভালো সাংবাদিকতা

Update Time : ০৬:৫৩:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ জুন ২০২৩
বেশ কিছুদিন আগের কথা। কুমিল্লার এক সংবাদকর্মীর ফোনে ঘুম ভাঙলো। ফোন ধরতেই বললেন,
– ভাই, একটা নিউজ আছে, পাঠাবো? বললাম,
– কী নিউজ’? ব্যস্ত হয়ে বললেন,
– এমপি স্যারের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে আছি। ছবি আর নিউজ পাঠাচ্ছি। চরম বিরক্ত লাগলো। বললাম,
– স্যারের নিউজের গুরুত্ব কী’? বললেন,
– বিজ্ঞাপন আসবে ভাই’। বললাম,
– কয়টা নিউজের বিনিময়ে কয়টা বিজ্ঞাপন? ওপাশ থেকে বিব্রত হয়ে বললেন, – আগে নিউজগুলো প্রকাশ হোক তারপর ধরবো ভাই’। বললাম,
– আগে কি স্যার কোনো বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে সংবাদকর্মী বললেন,
– আগে নিউজ দিতে হবে ভাই, তাহলে বিজ্ঞাপন আসবে’।
২.
বছর খানেক আগের কথা। উত্তরাঞ্চলের এক জেলার একজন প্রভাবশালীর অনিয়ম নিয়ে নিউজ প্রকাশ হলো। তিনি হুমকি দিলেন- মামলা করবেন, প্রতিনিধিকেও দেখে নেবেন। সহকর্মী ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন,
– কী করা যায়? বললাম,
– ঐ ব্যক্তির বিষয়ে বর্তমান আর অতীতের আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করেন। সেগুলো বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন।
বেশ কিছুদিন পর জানা গেল ঐ প্রভাবশালী নীরব হয়ে গেছেন। মামলা দূরে থাক, বরং প্রতিনিধির সঙ্গে আপোষ করতে চান। এমনকি বিজ্ঞাপন দিয়ে সহায়তাও করতে চান।
উপরের দুটি ঘটনা শুধু মফস্বলেরই নয়, সাংবাদিকতার জাতীয় চিত্রও বটে। সংবাদকর্মীরা অর্থ আর ক্ষমতার প্রভাবে হয় প্রভাবিত হন কিংবা প্রভাবিত করেন। যখন কোনো গণমাধ্যম প্রভাবিত হয়, তখন ভালো সাংবাদিকতা না-ও হতে পারে। তবে যখন প্রভাবিত করার বিষয় আসে তখন ভালো সাংবাদিকতা ছাড়া তা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, ভালো সাংবাদিকতার শক্তির উৎস কী? কারা ভালো সাংবাদিকতার পথ তৈরি করতে পারেন?
৩.
গণমাধ্যমের এই দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কিছু বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। সেটা হলো, বর্তমানে সাংবাদিকতাকে আমরা নানাভাবে বিশেষায়িত করছি। যেমন ভালো সাংবাদিকতার সমার্থক হিসেবে সাহসী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কথা বলছি। কখনও জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার সঙ্গে মফস্বল সাংবাদিকতার দূরত্ব তৈরি করছি। অর্থাৎ সাংবাদিকতার গুণগত মানের বিচার করতে গিয়ে এমন তুলনামূলক শব্দগুলো প্রয়োগ করছি।
ঘটনা অনেকটা ‘জোর করে ধর্ষণ’ ধারণার মতো। এখানে ‘ধর্ষণ’ শব্দের সঙ্গে অতিরিক্ত ‘জোর’ জুড়িয়ে দিয়ে অতিশয় করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ কিংবা সাহসী শব্দ যুক্ত করে অতিরিক্ত বিশেষায়িত করা হচ্ছে। আমরা জাতীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করতে গিয়ে মফস্বল বা স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতাকে কম গুরুত্ব দিচ্ছি। টিকে থাকার জন্য বড় আয়ের উৎস হিসেবে রাজধানীকে সাংবাদিকতার লক্ষ্য করে নিয়েছি।
এর প্রধান কারণ সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য আর কাঠামো কয়েক দশকে অনেকটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। দেশে ক্ষমতামুখী রাজনীতি আর পুঁজির দাপট গণমাধ্যমের প্রচলিত নীতিবোধকে কোনঠাসা করেছে। গণমাধ্যম যেমন বিনিয়োগকারীদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, তেমনি সংবাদকর্মীরাও অজান্তেই প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক সময় বিজ্ঞাপনের চাপ প্রভাবিত হতে বাধ্য করছে। আর এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেজন্যই সাহসী, বস্তুনিষ্ঠ বিশেষণগুলো সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বেশি করে।
৪.
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো কিংবা উন্নয়নকর্মযজ্ঞে মগ্ন দেশগুলোর ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে স্বচ্ছতায় নিয়ে আসতে পারে। যাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পদ্ধতিগত অপচয় বা আত্মসাতের মাত্রা অনেকটা কমে আসবে। তৈরি হবে জবাবদিহিতা, সমাজে ফিরবে শৃঙ্খলা।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মতপ্রকাশ তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয় রাজনৈতিক আর ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে। যে কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দেয়। যা চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। দেশে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার চেয়ে মফস্বল সাংবাদিকতার গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ, কেন্দ্রীভুত উন্নয়ন সুষম উন্নয়নের পরিপন্থি। যে কারণে সুষম উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয়া স্থানীয় সরকারের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে মফস্বল সাংবাদিকতা।
নব্বই দশকে স্বৈরাচার পতনের পর সারাদেশে জেলা-উপজেলায় অসংখ্য স্থানীয় পত্রিকার জন্ম হয়। যা স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন, সুরাজনীতি, সুশিক্ষা, সুসংস্কৃতির বিকাশে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। একই সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিতও করতে থাকে। তবে এক পর্যায়ে ভালো সাংবাদিকতা, পরিকল্পনা, বিজ্ঞাপন আর বিনিয়োগ সংকটে পত্রিকাগুলো অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
৫.
এমন একটা বৈরী সময়েই তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতির হাত ধরে কয়েক বছরে স্থানীয় পর্যায়ে ইন্টারনেটভিত্তিক যে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো যাত্রা শুরু করেছে সেগুলো নতুন করে সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চাইলে ভালো উদ্যোগ আর পরিকল্পনায় ভালো সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনপ্রিয় আর প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে এসব পোর্টাল। যেখানে টেকসই বিজনেস মডেল তৈরি হতে পারে। হতে পারে সাংবাদিকতার ভিন্ন ধারাও।
এক্ষেত্রে ভালো সাংবাদিকতার পথ আর শক্তির উৎস বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। প্রশ্ন অনেক জটিল হলেও পথ একটাই, গণমাধ্যমকে লাভজনক করতে হবে। বিনিয়োগ করা অর্থ যদি ফেরৎ আসে তাহলে সাহসী ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা অগ্রসর হবেন। ঠিক তখনই ভালো কিংবা সাহসী সাংবাদিকতার পথ তৈরি হবে। বলতে গেলে, এটা দারিদ্রের দুষ্টুচক্রের মতোই ব্যাপার। গণমাধ্যমকে জনপ্রিয় করতে না পারলে বিজ্ঞাপনের আয় পাবেন না; বিজ্ঞাপনের আয় না পেলে গণমাধ্যম লাভজনক হবে না; আর লাভজনক না হলে ভালো সাংবাদিকতা হবে না; আর ভালো সাংবাদিকতা না থাকলে গণমাধ্যম জনপ্রিয় হবে না।
৬.
তাই গণমাধ্যমকে জনপ্রিয় আর লাভজনক করতে হলে ভালো সাংবাদিকতা করার ঝুঁকি নিতেই হবে। এজন্য আগে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব পরিহার করতে হবে। আবেগ কিংবা বিশ্বাসের ওপর ভর করা কোনো নৈতিকতা থেকেও বেরুতে হবে। বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী, মহল বা ধর্মের স্বার্থে নয়, গণমাধ্যমকে হতে হবে সাংবিধানিক আইন, সুশাসন আর গণতন্ত্রের পক্ষে। রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে হবে। তাহলেই গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা বাড়বে। জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে টেকসই বিজনেস মডেল বাস্তবায়ন সহজ হয়ে উঠবে।
লক্ষ্যে অটল থেকে সাহসী এই সাংবাদিকতা শুরু করা যেতে পারে মফস্বল থেকেই। সেটা পত্রিকা কিংবা অনলাইন উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক নতুন ধারার যে অনলাইন সাংবাদিকতা, সেখানে সাহসী প্রতিবেদনই কিন্তু সব নয়। কোনো পোর্টালকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য জনপ্রিয় ও গুণগত মানের কনটেন্ট তৈরিও করতে হবে। যার জন্য সঠিক পরিকল্পনা থাকা দরকার। কেননা, দিন শেষে ভালো আর জনপ্রিয় কনটেন্টই ভালো বিজনেস মডেল বাস্তবায়নে সহায়ক হয়।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আনন্দবাজার