সংগ্রামী নারী রাজদা বেগম (৫০)। প্রতি নিয়ত সংগ্রাম করেই চলে তার সংসার। দশ গ্রামের মানুষ তাকে ‘রাজমিস্ত্রি রাজদা’ নামেই জানে। এক সময় নির্মাণ কাজের জোগালদার হিসেবে কাজ শুরু করলেও এখন তিনি হেডমিস্ত্রি। প্রায় ২০ বছর যাবৎ রাজমিস্ত্রির কাজ করে নিজের সংসার চালাচ্ছেন তিনি। বিয়ের পরে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে।
নিজের সংসার চালানোর পাশাপাশি মেয়েকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। বৃদ্ধ মাকে বাড়িতে রেখে দেখভাল করছেন তিনি। মেয়ে শ্যামলী’র বিয়ের পর বৃদ্ধ মা রাবেয়া বেগমের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব হাঁসি মুখে নিয়েছেন তিনি। জীবন সংগ্রামী নারী রাজদা বেগমের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের মশিন্দা কান্দিপাড়া গ্রামের মৃত-বেল্লাল সরদারের মেয়ে তিনি। নিজ গ্রামসহ আশপাশের অন্তত ২০টি গ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন তিনি।
রাজমিস্ত্রি রাজদা বেগম জানান,‘প্রায় ২২ বছর পূর্বে একই এলাকার শাহীন হোসেনের সাথে তার পারিবারিক ভাবে বিবাহ হয়। বিয়ের দুই বছর পরেই গর্ভে ৬ মাসের সন্তান রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায় স্বামী শাহীন। অনেক বলার পরেও ভরণ-পোষণ দিতে রাজি হয়নি তার স্বামী। এ খবর শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে রাজদার। বাবা’র পরিবারের অবস্থাও বেশি ভাল ছিলো না। বাধ্য হয়ে গর্ভে ৭ মাসের সন্তান নিয়েই রাজমিস্ত্রির (জোগালদার) হিসাবে ২৫টাকা দিনমজুরীতে কাজ শুরু করেন। নানা চিন্তা ভাবনায় নিজের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিসহ। পেটের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে কষ্ট মেনে নিয়েই শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম। কাজ করতে করতেই জন্ম হয় মেয়ে শ্যামলীর। মেয়েকে নিয়েই মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটে যেতেন কাজ করতে। সেই পরিশ্রমের অর্থেই নিজের সংসার ও মেয়ের পড়াশোনা চলতো। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর রাজমিস্ত্রির(হেডমিস্ত্রি) হন তিনি। তখন মজুরীও বেশি পান। হঠাৎ করেই তার বৃদ্ধ মা রাবেয়া বেগমকেও আমার বাড়িতে আশ্রয় দিতে হয় কারণ তার ভাইয়েরা সবাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। তখন মা ও মেয়ের দায়িত্ব তার কাঁধে পরে। দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পরিশ্রমও বেড়ে যায়। এভাবেই কেঁটে যায় ২০ বছর। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ২৫ টাকা দিনমজুরী থেকে এখন ৫০০ টাকা মজুরী পান তিনি। মেয়েকে বিয়ে দেবার পর বৃদ্ধ মা রয়েছে বাড়িতে। বাকি জীবন যতদিন পরিশ্রম করতে পারি ততদিন এভাবেই কাজ করে সংসার চালাবো। অন্যের কাছে সহযোগিতা কখনও চাইতে যাইনি। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এভাবেই কেটে যাবে জীবন।’সরকারী কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘কখনই অন্যের কাছ থেকে সহযোগিতা চাইনি। আর সরকারী কোন সহযোগিতা এখন পর্যন্ত পাইনি।’
নির্মাণ শ্রমিক (জোগালদার) আজাদুল প্রামানিং বলেন,‘দীর্ঘদিন যাবৎ রাজদা বেগমের সাথে কাজ করতেছি। কখনও তাকে কোন কিছু নিয়ে আফসোস করতে দেখিনি। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত অনেক পরিশ্রম করেন তিনি। যা আমরাও পারিনা। আমি তো এখনও জোগালদার হয়েই রইলাম। আর রাজদা বেগম বড় মিস্ত্রি। তার মজুরী ৫০০ টাকা আর আমাদের ৩৫০ টাকা। রাজদা বেগমকে দেখে আমরাও অনেক উৎসাহ পাই। সে নারী হয়ে এতকিছু করতে পারে আমরা কেন পারবো না। বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা সরকারী কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মাধব কুমার কুন্ডু জানান,‘রাজমিস্ত্রি রাজদা বেগম এই সমাজের অবহেলীত নারীদের উদাহরণ। একজন সংগ্রামী নারী কিভাবে তার জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন তার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে রাজদা বেগমকে দেখে।’
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা আক্তার জানালেন, খোঁজ খবর নিয়ে রাজদা’র পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে উপজলা প্রশাাসন।