মোঃ মাজেম আলী মলিন
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গত তিন বছর যাবত চেষ্টা চলছে করোনাভাইরাসের ক্ষত শুকানোর । ওই মহামারীতে দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতি পুরণ এখনও কাটানো যায়নি। যখন আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হতে চলছিলো তখনি শুরু হলো কোটা সংস্কার আন্দোলন, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় ১৬ জুন থেকে ধাপে ধাপে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
বছরের শুরুতেই বেশ কিছুটা সময়জুড়ে শৈত্যপ্রবাহের পর তীব্র দাবদাহ ও বন্যায় ক্ষতি পুশিয়ে ঘুরে দাাঁড়াচ্ছিল শিক্ষাকার্যক্রম ঠিক তখনই শুরু হল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে অচলাবস্থা। একের পর এক অনাকাঙ্খিত ছুটিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ক্ষত ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। দফায় দফায় শ্রেণি কার্যক্রম ব্যহতসহ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাগ্রহ-অনীহা বাড়িয়ে তুললে তা বার্ষিক মূল্যায়ন ও চূড়ান্ত পরীক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা শিক্ষক ও অভিভাবকদের। এখন প্রশ্ন হলো এসব ক্ষত শুকাবে কীভাবে?
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে নজিরবিহীন সহিংসতার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ১৬ জুলাই থেকে ধাপে ধাপে বন্ধ করা হয়েছে দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংঘাত বাড়তে থাকলে জারি করা হয় কারফিউ। আস্তে আস্তে কারফিউও শিথিল হয়, সচল হয় অফিস-আদালত।তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ কতদিনে ফিরবে সেটি এখনও হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কারন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও চলছে শিক্ষক সংস্কারের নামে শিক্ষকদের পালাবদল। এক শ্রেণির স্বার্থনেশি মহল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে এ সব ঘৃণিত কাজে। অপর দিকে আন্দোলন শেষ হলেও শিক্ষার্থীরা নানা শ্রেণি বৈষম দুর করতে এখনো মাঠেই দেখা যাচ্ছে। অথচ যে কাজগুলো করা রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব সেগুলো কেন এখনো শিক্ষার্থীরা করবে তা বোধগম্য নয়।
স্কুলের পাশাপাশি ব্শ্বিবিদ্যালয়েও পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। পেনশন স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতি-বিক্ষোভে আগে থেকেই ক্লাস বন্ধ ছিল। এখন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘ সেশনজটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিছুক বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন , বারবার বন্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট অনেক কষ্ট হবে । নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শিখন ঘাটতির ধাক্কা কাটাতে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণি কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানোর ডাবল শিফট করার পরামর্শ অভিভাবকসহ শিক্ষাবিদদের। তারা সময় বাড়িয়ে অতিরিক্ত ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণে সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ কে আজাদ বলছেন, প্রয়োজনে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার এবং যে কোনো সরকারি ছুটির দিনও ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে ক্ষতি যতটা পুষিয়ে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই করতে হবে। এপরিস্থিতি থেকে উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক আজাদ বলছেন, শ্রেণিকার্যক্রমের সময়সূচি বাড়িয়ে বাড়তি ক্লাস নেওয়া যেতে পারে।”
কীভাবে শিখন ঘাটতি পূরণ হবে, তা নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকরাও রয়েছেন শঙ্কায়।
ঢাকার শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিধান কুমার সাহা বলেন, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হবে। কারণ এখনকার লেখাপড়া কিন্তু পুরোটাই ক্লাস অ্যাক্টিভিটি বেইজড। সেটা করতে হলে স্কুল খোলা রাখার কোনো বিকল্প নেই। নানা রকম সমস্যায় আমরা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি।”
২০২৪ সালের প্রথমার্ধের বেশি কিছু সময়জুড়ে জাতীয় নির্বাচন, শৈত্যপ্রবাহ এবং দাবদাহের কারণে স্কুলে শ্রেণি কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছিলো। আবার জুনের শেষে ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকায় ষান্মাসিক মূল্যায়ন পিছিয়ে ৩ জুলাই থেকে শুরু হয়। চারটি পরীক্ষার পরেই কোটা আন্দোলনের চলমান পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায় ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ষান্মাসিক মূল্যায়ন।
প্রিয়ন্তি নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাস বন্ধ থাকলে বাসায় তেমন পড়াশোনা হয় না। কারণ ক্লাসে বোঝানোর ব্যাপার থাকে। নিজে বই পড়ে কিছুটা আইডিয়া পাওয়া যায়। কিন্তু তেমন লাভ হয় না। আর বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। গরমের সময়ও বেশ কয়েকদিন স্কুল বন্ধ ছিল। পরে স্কুল খোলার পর অনেক চাপ পরে তখন কষ্ট বেড়ে যায়।”
দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে শঙ্কিত গোলাম মর্তুজা নামের একজন অভিভাবক বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারনে এক ধরনের ক্ষতি হচ্ছে বাচ্চাদের। আবার স্কুল খুললে আরেক ধরনের ভয় কাজ করবে। স্কুলে যাওয়া বা ফেরার পথে সহিংসতায় পড়ে গেলে প্রাণে বাঁচাই কঠিন হয়ে যাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাস না করলে তো বাচ্চারা পিছিয়ে পড়বে। আগের সেই কারিকুলাম না যে, বাসায় বসিয়ে সিলেবাস কমপ্লিট করাব। এখন তো প্রচুর গ্রুপ ওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট থাকে ওদের। তাই স্কুল বন্ধ থাকলে বই শেষ করতে পারবে না। তখন তো শিখন ঘাটতি থেকে যাবে।”
যেসব শিক্ষার্থী আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তাদের অভিভাবকদের শঙ্কা, শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেললে তার প্রভাব পড়বে ফলাফলে। ঢাকার মিরপুরের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা জেসমিন সুলতানা ক্লাস বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরে বলেন,ওদের এসএসসি পরীক্ষার আর কয়েকটা মাস বাকি। এমনিতেই ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে চায় না। স্কুল-কোচিং খোলা থাকলে তাও কিছুটা পড়ালেখা হয়। এখন একেবারে বই নিয়ে বসছে না। সারা দিন গেইমস খেলছে মোবাইলে। এভাবে তো সব পড়া ভুলে যাবে। পরে রেজাল্টটা খারাপ হলে সারা জীবনের ধাক্কা হয়ে থাকবে।”
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন,যে পরীক্ষাগুলো স্থগিত হয়েছে, সেগুলো নেওয়ার বিষয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। আমরা আশা করছি যথা সময়ে পরীক্ষাগুলো নিতে পারব।”তাহলে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন মনে করেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে পরিণতি এনেছে, তাতে শিক্ষার সবক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতামূলক মানসিকতার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।“অনেক শিক্ষার্থীই এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে। সেই পরিস্থিতি থেকে ফিরিয়ে আনতে সবাইকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। সবাই আন্তরিক থাকলে, অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। শিক্ষার্থীদেরও এখন বাড়তি ঝামেলা এড়িয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে।” আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষাদান করলে ঘাটতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন বিধান সাহা।বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ বলছেন, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ক্যাম্পাসে পেশীশক্তির প্রভাব কমাতে হবে।“ছাত্র সংগঠনগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় হওয়ার জন্য বাইরে থেকে চাপ না আসলে বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে চালানো যাবে। এর মানে এই নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। পরিশীলিত, সুন্দর, যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা থাকতে হবে তাহলেই শিক্ষার ক্ষত অতিদ্রুত শুকিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।”
মোঃ মাজেম আলী মলিন, সাংবাদিক,কলামিস্ট ডেইলী অবজারভার, প্রকাশক ও সম্পাদক দৈনিক বনলতা।