রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্মার্ট ভিলেজই হতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্মার্ট ভিলেজ হতে পারে সেই মূল ভিত্তি যা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে। যেহেতু বাংলাদেশের ৮০% লোক প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত তাই আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ এবং টেকসই উন্নয়নের সমন্বয়ে স্মার্ট ভিলেজ গড়ে তোলা শুধুমাত্র গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে না, বরং জাতীয় উন্নয়নেও রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শহরের সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দিয়ে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তৈরি হবে এমন এক সমাজ, যেখানে প্রযুক্তির শক্তি কাজে লাগিয়ে প্রতিটি মানুষ তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারবে।
বাংলাদেশে স্মার্ট ভিলেজের প্রয়োহনীয়তা ও সম্ভাবনা: বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মূল শেকড় গ্রামীণ অঞ্চল। এই গ্রামীণ সমাজ উন্নয়নের সঠিক পথে এগিয়ে নিতে হলে “স্মার্ট ভিলেজ” ধারণা একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হতে পারে। স্মার্ট ভিলেজ হলো এমন একটি ধারণা যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত অবকাঠামো এবং সেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। এটি শুধু শহরের সঙ্গে গ্রামের ব্যবধান কমাবে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
স্মার্ট ভিলেজের গুরুত¦ ঃ ডিজিটাল সংযুক্তিরমাধ্যমে স্মার্ট ভিলেজে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যাবে। এটি শিক্ষার্থী, কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করবে। স্মার্ট ভিলেজে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি কার্যক্রম চালানো সম্ভব। ড্রোনের সাহায্যে ফসলের পর্যবেক্ষণ, আধুনিক সেচব্যবস্থা এবং কৃষি বিষয়ক তথ্যপ্রযুক্তি সেবা কৃষকদের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করবে। এছাড়াও স্মার্ট ভিলেজে অনলাইন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করা যাবে। এতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আধুনিক স্বাস্থ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা সম্ভব হবে। এতে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হবে এবং চিকিৎসা ব্যয়ও কমবে। পরিবেশ সুরক্ষায় স্মার্ট ভিলেজ পরিকল্পনায় পরিবেশ-বান্ধব অবকাঠামো এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহার গুরুত্ব পাবে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ড. এম এস স্বামীনাথন (ভারতীয় কৃষিবিদ) বলেছেন,”স্মার্ট ভিলেজ কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে নয়, এটি শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার উপরও গুরুত্ব দেয়।” ড. রিচার্ড ব্যাক (শিক্ষাবিদ) এর মতে ”স্মার্ট ভিলেজের ধারণা গ্রামীণ এবং শহুরে এলাকার মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনে। এটি প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যাগুলির কার্যকর সমাধান প্রদান করে।” অ্যানা হ্যাজাওে সমাজকর্মীর মতে,স্মার্ট ভিলেজ এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে সমতা নিয়ে আসে। এটি গ্রামের জনগণকে স্বাবলম্বী করে তোলে এবং শহরের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়তা করে।”
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি স্মার্ট ভিলেজের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে নিজস্বতায় সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে স্মার্ট বাংলাদেশ স্বপ্নের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের চিন্তা থেকেই এক সময়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। স্মার্ট ভিলেজ করার কারণে এই গ্রামে এখন তিনটি বাড়ীতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। জাপানি দাতা সংস্থা জাইকা প্রকল্পের সহায়তায় পাঁচটি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন, গ্রামের নামে ফেসবুক গ্রæপ খোলা হয়েছে, ৭০ শতক জমিতে পারিবারিক পুষ্টির বাগান স্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে নিয়মিত নিরাপদ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন হচ্ছে এবং ২০টি বাড়িতে রান্নাঘরের আবর্জনা দিয়ে জৈবসার তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে থেকে তিন জনকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ প্রদানন করা হয়েছে,গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য ৯ জনকে আউটসোর্সিং কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, স্মার্ট ভিলেজ হিজলীতে ইন্টারনেট সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, গর্ভবতী মায়েদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। গ্রামের ২০২টি টিউবওয়েল আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে। যুবোন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে হিজলী গ্রামে স্মার্ট যুব ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে, যাতে গ্রামের যুব সমাজ মোবাইল ফোনে আসক্তি কমানো যায়। মাত্র ছয় মাসের প্রচেষ্টায় দেশের প্রত্যন্ত এই হিজলী গ্রাম এখন হয়ে উঠেছে প্রথম সারির স্মার্ট ভিলেজ ।
সম্ভাবনা : স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোকে দেশের উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করা সম্ভব। এটি শুধু গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথও প্রশস্ত করবে। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ একটি টেকসই ও স্মার্ট জাতি হিসেবে বিশ্বে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের মূলভিত্তি হলো গ্রামীণ অঞ্চল। কারণ দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। গ্রামীণ এলাকা কৃষি, মৎস্য, পশুপালন ও ক্ষুদ্র শিল্পের কেন্দ্রস্থল।কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড এবং এর ভিত্তি গ্রামীণ জনপদ। কৃষিখাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটালে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে যা দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ উন্নয়ন মানে, অবকাঠামো উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামের বেকার জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো সম্ভব। এতে দারিদ্র্যের হার কমবে এবং শহরমুখী অভিবাসনও হ্রাস পাবে। সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শিক্ষার প্রসার ঘটাবে যা গ্রামীণ উন্নয়নে অপরিহার্য। শিক্ষা প্রসারের ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন সড়ক, বিদ্যুৎ, সেচব্যবস্থা ও ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখবে। স্মার্ট ভিলেজ কেবল একটি ধারণা নয়, এটি একটি সম্ভাবনার দিগন্ত যা স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত্তিকে মজবুত করতে পারে। প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকতার সমন্বয়ে স্মার্ট ভিলেজ শুধু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করবে না, বরং সমগ্র জাতির টেকসই উন্নয়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই,স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্মার্ট ভিলেজ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। একীভূত প্রচেষ্টা, সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব, যা আমাদের একটি উন্নত, স্বনির্ভর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করবে। মোঃ মাজেম আলী মলিন সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট ডেইলী অবজারভার, প্রকাশক ও সম্পাদক দৈনিক বনলতা।

Tag :
About Author Information

Daily Banalata

Popular Post

বসন্ত মানেই রক্তিম পাপড়ির মাঝে ছড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ কবিতার গল্প!

স্মার্ট ভিলেজই হতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি

Update Time : ১০:৫৭:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্মার্ট ভিলেজ হতে পারে সেই মূল ভিত্তি যা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে। যেহেতু বাংলাদেশের ৮০% লোক প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত তাই আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ এবং টেকসই উন্নয়নের সমন্বয়ে স্মার্ট ভিলেজ গড়ে তোলা শুধুমাত্র গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে না, বরং জাতীয় উন্নয়নেও রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শহরের সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দিয়ে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তৈরি হবে এমন এক সমাজ, যেখানে প্রযুক্তির শক্তি কাজে লাগিয়ে প্রতিটি মানুষ তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারবে।
বাংলাদেশে স্মার্ট ভিলেজের প্রয়োহনীয়তা ও সম্ভাবনা: বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মূল শেকড় গ্রামীণ অঞ্চল। এই গ্রামীণ সমাজ উন্নয়নের সঠিক পথে এগিয়ে নিতে হলে “স্মার্ট ভিলেজ” ধারণা একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হতে পারে। স্মার্ট ভিলেজ হলো এমন একটি ধারণা যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত অবকাঠামো এবং সেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। এটি শুধু শহরের সঙ্গে গ্রামের ব্যবধান কমাবে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
স্মার্ট ভিলেজের গুরুত¦ ঃ ডিজিটাল সংযুক্তিরমাধ্যমে স্মার্ট ভিলেজে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যাবে। এটি শিক্ষার্থী, কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করবে। স্মার্ট ভিলেজে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি কার্যক্রম চালানো সম্ভব। ড্রোনের সাহায্যে ফসলের পর্যবেক্ষণ, আধুনিক সেচব্যবস্থা এবং কৃষি বিষয়ক তথ্যপ্রযুক্তি সেবা কৃষকদের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করবে। এছাড়াও স্মার্ট ভিলেজে অনলাইন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করা যাবে। এতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আধুনিক স্বাস্থ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা সম্ভব হবে। এতে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হবে এবং চিকিৎসা ব্যয়ও কমবে। পরিবেশ সুরক্ষায় স্মার্ট ভিলেজ পরিকল্পনায় পরিবেশ-বান্ধব অবকাঠামো এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহার গুরুত্ব পাবে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ড. এম এস স্বামীনাথন (ভারতীয় কৃষিবিদ) বলেছেন,”স্মার্ট ভিলেজ কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে নয়, এটি শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার উপরও গুরুত্ব দেয়।” ড. রিচার্ড ব্যাক (শিক্ষাবিদ) এর মতে ”স্মার্ট ভিলেজের ধারণা গ্রামীণ এবং শহুরে এলাকার মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনে। এটি প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যাগুলির কার্যকর সমাধান প্রদান করে।” অ্যানা হ্যাজাওে সমাজকর্মীর মতে,স্মার্ট ভিলেজ এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে সমতা নিয়ে আসে। এটি গ্রামের জনগণকে স্বাবলম্বী করে তোলে এবং শহরের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়তা করে।”
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি স্মার্ট ভিলেজের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে নিজস্বতায় সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে স্মার্ট বাংলাদেশ স্বপ্নের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের চিন্তা থেকেই এক সময়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। স্মার্ট ভিলেজ করার কারণে এই গ্রামে এখন তিনটি বাড়ীতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। জাপানি দাতা সংস্থা জাইকা প্রকল্পের সহায়তায় পাঁচটি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন, গ্রামের নামে ফেসবুক গ্রæপ খোলা হয়েছে, ৭০ শতক জমিতে পারিবারিক পুষ্টির বাগান স্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে নিয়মিত নিরাপদ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন হচ্ছে এবং ২০টি বাড়িতে রান্নাঘরের আবর্জনা দিয়ে জৈবসার তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে থেকে তিন জনকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ প্রদানন করা হয়েছে,গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য ৯ জনকে আউটসোর্সিং কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, স্মার্ট ভিলেজ হিজলীতে ইন্টারনেট সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, গর্ভবতী মায়েদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। গ্রামের ২০২টি টিউবওয়েল আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে। যুবোন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে হিজলী গ্রামে স্মার্ট যুব ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে, যাতে গ্রামের যুব সমাজ মোবাইল ফোনে আসক্তি কমানো যায়। মাত্র ছয় মাসের প্রচেষ্টায় দেশের প্রত্যন্ত এই হিজলী গ্রাম এখন হয়ে উঠেছে প্রথম সারির স্মার্ট ভিলেজ ।
সম্ভাবনা : স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোকে দেশের উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করা সম্ভব। এটি শুধু গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথও প্রশস্ত করবে। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ একটি টেকসই ও স্মার্ট জাতি হিসেবে বিশ্বে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের মূলভিত্তি হলো গ্রামীণ অঞ্চল। কারণ দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। গ্রামীণ এলাকা কৃষি, মৎস্য, পশুপালন ও ক্ষুদ্র শিল্পের কেন্দ্রস্থল।কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড এবং এর ভিত্তি গ্রামীণ জনপদ। কৃষিখাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটালে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে যা দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ উন্নয়ন মানে, অবকাঠামো উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামের বেকার জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো সম্ভব। এতে দারিদ্র্যের হার কমবে এবং শহরমুখী অভিবাসনও হ্রাস পাবে। সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শিক্ষার প্রসার ঘটাবে যা গ্রামীণ উন্নয়নে অপরিহার্য। শিক্ষা প্রসারের ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন সড়ক, বিদ্যুৎ, সেচব্যবস্থা ও ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখবে। স্মার্ট ভিলেজ কেবল একটি ধারণা নয়, এটি একটি সম্ভাবনার দিগন্ত যা স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত্তিকে মজবুত করতে পারে। প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকতার সমন্বয়ে স্মার্ট ভিলেজ শুধু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করবে না, বরং সমগ্র জাতির টেকসই উন্নয়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই,স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্মার্ট ভিলেজ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। একীভূত প্রচেষ্টা, সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব, যা আমাদের একটি উন্নত, স্বনির্ভর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করবে। মোঃ মাজেম আলী মলিন সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট ডেইলী অবজারভার, প্রকাশক ও সম্পাদক দৈনিক বনলতা।