বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সন্তর্পণে পুষে রাখা অনুভূতি – পর্ব-৫

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৪:৩১:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ নভেম্বর ২০২০
  • ১১৭ Time View

প্রভাষক নাসরিন সুলতানা রুমা

সন্তর্পণে পুষে রাখা অনুভূতি পর্ব-৫

খুব ছোটবেলা থেকেই রামু দাদা( আবেদ আলী),কুদ্দুস কাকা টগর কাকা,কুদ্দুস ভাই,ইছারদ্দি ভাইসহ অন্যান্য দের আমাদের ঘর গৃহস্হালি দেখার জন্য বাৎসরিক চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হতো।তারা আমাকে খুব স্নেহ করতেন।তারা আমাদের টঙ্গীঘরে থাকতেন।টঙ্গীঘর বা বাহিরবাড়ি বা বৈঠকখানা।তাদের দুএকজন মুনু বিড়ি,কানু বিড়ি খেতেন।রামু দাদার হুক্কা ফুরুত ফুরুত শব্দে কেমন যেন একটা ব্যাপার ছিল।যতদূর মনে পড়ে নারকেলের মালা ছিদ্র করে এর ভেতরে পানি দেয়া হতো।তাতে যুক্ত করা ছিল কাঠের ছিদ্রবিশিষ্ট দন্ড।মাথায় গর্তয়ালা গোলাকার অংশ।সেখানে আগুন,ছাইজাতীয় কিছু রাখা হতো।রামুদাদার হুক্কার টানের,শব্দের সাথে সাথে ওই গোলাকার জায়গাটায় আগুন জ্বলে উঠার সাথে সাথে আমার কৌতূহলও বেড়ে যেত।দাদার কাজের ব্যাস্ততার সুযোগ নিয়ে বেশ ক’বার হুক্কায় টান মেরে শব্দে ভাসিয়েছি আমরা বন্ধুরা! এতে একটা মাদকীয় গন্ধ ছিল!খেলেছি ঘর কাটা কাঠের ফর্মে বাঘবন্দি/ বাঘবকরী খেলা।গরমকালে খড়ের ছাউনি দেয়া ঘর ও বারান্দাটি ছিল ছোটখাট আড্ডাখানা।
রামুদাদার পিছে পিছে খাপালের জমিতে যেতাম করলা তুলতে।সবুজ পাতার ভেতরে সবুজ করলা খুঁজে বের করে ঝাঁকায় রাখাটা ছিল আনন্দের।এই করলাগাছের ব্যাপারটা এমনই।কিছুটা ছুপা রুস্তম টাইপের।দেখা যায় না কিন্ত ডিটেকটিভ স্টাইলে খুঁজলে এর রহস্য ভেদ করা যায় মানে পাওয়া যায়।

তারপরে লম্বু,কৃষ্ণবর্ণের রামুদাদা সারা গায়ে মাথায় সর্ষের তেল মেখে নন্দকূঁজা নদী থেকে ডুবের পর ডুব মেরে,তেল ভাসিয়ে ঘরে ফিরে গামছায় গা মুছতে মুছতে মা’কে তাগাদা দিয়ে বলেন,” সরকারের বিটি আমাক ভাত দ্যাও।খুব খিদি লাগছে।”রামু দাদা বারান্দায় বসে গ্রোগ্রাসে টেংরা মাছ আর করলার তরকার দিয়ে। খেতে থাকে আর বলতে থাকেন,”সরকারের বিটি এতো কম কল্ল্যি রান্দ ক্যা।খায়্যা অ্যাংকি ভরেনা।তোমার হাতে কল্ল্যির তুরকারি খুব শদ লাগে।”এদিকে আমার মা বলেন,”মাছে বেশি শব্জি দিলে শদ লাগেনা,তাই কম দিছি।বেশি শব্জি দিলে রুমার আব্বা রাগ করবি।”

আমাদের ছিপনৌকাতে করে মা গুরুদাসপুরে অফিসে, বাপের বাড়ি যেতেন।রামুদাদা নৌকা ঠেলে নিয়ে যেতেন।ওই নৌকায় করে নন্দকূঁজা নদীর কয়েক জায়গায় জালি পেতে রাখা হতো।সকালবেলায় জালে ধরা পরতো গাগর,আইড়,পাবদা,বাচাসহ নানা প্রজাতির মাছ।তখন আমার মায়ের মুখ হাসিতে চকচক করতো।মা আমাকে বলতেন,”যাহ তোর খালার বাড়ি মাছ দিয়ে আয়।”আমি খুশিতে খালার বাড়ি চলে যেতাম।

মায়ের মুখে শুনেছি নানারবাড়িত মাছের কানে বাঁশ ঢুকিয়ে দুইজন লোক বড় বড় মাছ নিয়ে আসতেন।আমার নানী নানা পদ রান্না করতেন।টাকী ভর্তা,ছোটমাছের নানা পদ,মাছভাজা,বড় মাছের রান্না করতেন।আমার মেছো হবার পিছনে কারণটা পারিবারিক।বিশেষ করে নদী,বিলকে ঘিরে জীবনপ্রবাহ।

চলনবিল এলাকার মানুষদের ছোটমাছ রান্নাটা অসাধারণ।অল্প মশলায় মাছ পুরপুরি( চচ্চড়ি) করা হয়।মলা,চেলা,পুটি,রায়াক,টেংরা, ছোট গুচি টাইপের মাছে পেয়াজ রসুন, কাঁচামরিচ কুচি করে তাতে একটু লবন, হলুদ,তেল দিয়ে হাতে মেখে আলু/ বেগুন/ ঝিঙ্গা/ধুন্দল/ কচু/ মুলা/ সীম / ডাটা কুচি করে মিশিয়ে অল্প পানিতে রস মেরে রান্না করা হয়।কখনো কখনো মরিচগুড়া,ধনেগুড়া, পেয়াজ মরিচ বাটাও দেয়া হয়।তবে বাড়ির পাশে জমিতে বিঘাকে বিঘা ধনেপাতা হয়ে থাকলেও একমুঠো তুলে এনে টাটকা ধনেপাতা মাছে ফেলে দেয়া হতোনা।হালে কেউ কেউ খায়।যারা শহরমুখী তারা।কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কারণে প্রায় বাড়িতেই ফসলাদির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজের লোক প্রয়োজন হয়।ধনেপাতা দেয়া তরকারি কিংবা কম মশলার তরকারি উনাদের পাতে দিলে সোজা উগলে দিবে!সেই বাড়ির রান্নার বদনাম হবে।অথচ ধনেগুড়াটা না হলে রান্না হবেনা!

শীতকালে মায়ের হাতের কুমড়াবড়ি ও লাল আলু দিয়ে রান্না করা শোল মাছের পদ অতুলনীয়।মাছের ঘাটি/ ঘন্ট উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে শীতকালে উল্লেখযোগ্য রন্ধনশৈলী।আইড় অথবা বোয়াল মাছ ও সিদ্ধ আলু ছিল এই রান্নার প্রধান উপকরণ।আবার কখনো আলুর সাথে বেগুন যোগ করা হতো কিংবা লাউ সাথে টাকী অথবা বোয়াল,আইড় মাছ।।রান্না শেষ হবার আগে পেয়াজ, জিরা, তেজপাতা ভেজে বেটে তরকারির ঝোলেন গুলিয়ে মিশিয়ে দেয়া হতো( ভাজনা)।হালে ওইসব মাছের জায়গা দখল করেছে রুই,সিলভারকার্পসহ অন্যান্য মাছ।যেগুলো কুলখানিতে খাওয়ানো হয়।সাথে দেয়া হয় ডেজার্ট হিসেবে দেয়া হয় পায়েস।বিভিন্ন মজলিসে এমনভাবে ঘাটি ও পায়েস পরিবেশন করা হয় যেন বস্সারে.. সাদেক আলী,খাবি কত খাহ!আমি ভাজনা বাটাতে পটু ছিলাম।তেজপাতাগুলো চুড়মুড় করে ভেঙ্গে কিছুটা পানি নিয়ে ক্রমাগত বেটে একটা মোলায়েম পেস্ট তৈরি করা।

শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম ঝরনা ফুফু হারিকেনের গ্লাস মুছতে মুছতে খাবার জন্য বলছেন।রোদে পিঠ দিয়ে গরমভাতের সাথে নতুন আলুভর্তা,টাকীমাছের ভর্তা,সীমআলু ভাজি আর শিং মাগুর,গুচি,বাইম,কই মাছ আলুর ভাজনা দেয়া ঝালে ঝোলের তরকারি ডালেরবড়ি, ফুলকপি করলামাছের সেই নষ্টালজিয়ায় কিংবা নতুন আলুতে দেশি মোরগের তরকারির টানে মায়ের আঁচলে বন্দী হতে মন চায়! মন ছুটেছে সেথায়….

চলবে..

Tag :

সন্তর্পণে পুষে রাখা অনুভূতি – পর্ব-৫

Update Time : ০৪:৩১:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ নভেম্বর ২০২০

প্রভাষক নাসরিন সুলতানা রুমা

সন্তর্পণে পুষে রাখা অনুভূতি পর্ব-৫

খুব ছোটবেলা থেকেই রামু দাদা( আবেদ আলী),কুদ্দুস কাকা টগর কাকা,কুদ্দুস ভাই,ইছারদ্দি ভাইসহ অন্যান্য দের আমাদের ঘর গৃহস্হালি দেখার জন্য বাৎসরিক চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হতো।তারা আমাকে খুব স্নেহ করতেন।তারা আমাদের টঙ্গীঘরে থাকতেন।টঙ্গীঘর বা বাহিরবাড়ি বা বৈঠকখানা।তাদের দুএকজন মুনু বিড়ি,কানু বিড়ি খেতেন।রামু দাদার হুক্কা ফুরুত ফুরুত শব্দে কেমন যেন একটা ব্যাপার ছিল।যতদূর মনে পড়ে নারকেলের মালা ছিদ্র করে এর ভেতরে পানি দেয়া হতো।তাতে যুক্ত করা ছিল কাঠের ছিদ্রবিশিষ্ট দন্ড।মাথায় গর্তয়ালা গোলাকার অংশ।সেখানে আগুন,ছাইজাতীয় কিছু রাখা হতো।রামুদাদার হুক্কার টানের,শব্দের সাথে সাথে ওই গোলাকার জায়গাটায় আগুন জ্বলে উঠার সাথে সাথে আমার কৌতূহলও বেড়ে যেত।দাদার কাজের ব্যাস্ততার সুযোগ নিয়ে বেশ ক’বার হুক্কায় টান মেরে শব্দে ভাসিয়েছি আমরা বন্ধুরা! এতে একটা মাদকীয় গন্ধ ছিল!খেলেছি ঘর কাটা কাঠের ফর্মে বাঘবন্দি/ বাঘবকরী খেলা।গরমকালে খড়ের ছাউনি দেয়া ঘর ও বারান্দাটি ছিল ছোটখাট আড্ডাখানা।
রামুদাদার পিছে পিছে খাপালের জমিতে যেতাম করলা তুলতে।সবুজ পাতার ভেতরে সবুজ করলা খুঁজে বের করে ঝাঁকায় রাখাটা ছিল আনন্দের।এই করলাগাছের ব্যাপারটা এমনই।কিছুটা ছুপা রুস্তম টাইপের।দেখা যায় না কিন্ত ডিটেকটিভ স্টাইলে খুঁজলে এর রহস্য ভেদ করা যায় মানে পাওয়া যায়।

তারপরে লম্বু,কৃষ্ণবর্ণের রামুদাদা সারা গায়ে মাথায় সর্ষের তেল মেখে নন্দকূঁজা নদী থেকে ডুবের পর ডুব মেরে,তেল ভাসিয়ে ঘরে ফিরে গামছায় গা মুছতে মুছতে মা’কে তাগাদা দিয়ে বলেন,” সরকারের বিটি আমাক ভাত দ্যাও।খুব খিদি লাগছে।”রামু দাদা বারান্দায় বসে গ্রোগ্রাসে টেংরা মাছ আর করলার তরকার দিয়ে। খেতে থাকে আর বলতে থাকেন,”সরকারের বিটি এতো কম কল্ল্যি রান্দ ক্যা।খায়্যা অ্যাংকি ভরেনা।তোমার হাতে কল্ল্যির তুরকারি খুব শদ লাগে।”এদিকে আমার মা বলেন,”মাছে বেশি শব্জি দিলে শদ লাগেনা,তাই কম দিছি।বেশি শব্জি দিলে রুমার আব্বা রাগ করবি।”

আমাদের ছিপনৌকাতে করে মা গুরুদাসপুরে অফিসে, বাপের বাড়ি যেতেন।রামুদাদা নৌকা ঠেলে নিয়ে যেতেন।ওই নৌকায় করে নন্দকূঁজা নদীর কয়েক জায়গায় জালি পেতে রাখা হতো।সকালবেলায় জালে ধরা পরতো গাগর,আইড়,পাবদা,বাচাসহ নানা প্রজাতির মাছ।তখন আমার মায়ের মুখ হাসিতে চকচক করতো।মা আমাকে বলতেন,”যাহ তোর খালার বাড়ি মাছ দিয়ে আয়।”আমি খুশিতে খালার বাড়ি চলে যেতাম।

মায়ের মুখে শুনেছি নানারবাড়িত মাছের কানে বাঁশ ঢুকিয়ে দুইজন লোক বড় বড় মাছ নিয়ে আসতেন।আমার নানী নানা পদ রান্না করতেন।টাকী ভর্তা,ছোটমাছের নানা পদ,মাছভাজা,বড় মাছের রান্না করতেন।আমার মেছো হবার পিছনে কারণটা পারিবারিক।বিশেষ করে নদী,বিলকে ঘিরে জীবনপ্রবাহ।

চলনবিল এলাকার মানুষদের ছোটমাছ রান্নাটা অসাধারণ।অল্প মশলায় মাছ পুরপুরি( চচ্চড়ি) করা হয়।মলা,চেলা,পুটি,রায়াক,টেংরা, ছোট গুচি টাইপের মাছে পেয়াজ রসুন, কাঁচামরিচ কুচি করে তাতে একটু লবন, হলুদ,তেল দিয়ে হাতে মেখে আলু/ বেগুন/ ঝিঙ্গা/ধুন্দল/ কচু/ মুলা/ সীম / ডাটা কুচি করে মিশিয়ে অল্প পানিতে রস মেরে রান্না করা হয়।কখনো কখনো মরিচগুড়া,ধনেগুড়া, পেয়াজ মরিচ বাটাও দেয়া হয়।তবে বাড়ির পাশে জমিতে বিঘাকে বিঘা ধনেপাতা হয়ে থাকলেও একমুঠো তুলে এনে টাটকা ধনেপাতা মাছে ফেলে দেয়া হতোনা।হালে কেউ কেউ খায়।যারা শহরমুখী তারা।কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কারণে প্রায় বাড়িতেই ফসলাদির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজের লোক প্রয়োজন হয়।ধনেপাতা দেয়া তরকারি কিংবা কম মশলার তরকারি উনাদের পাতে দিলে সোজা উগলে দিবে!সেই বাড়ির রান্নার বদনাম হবে।অথচ ধনেগুড়াটা না হলে রান্না হবেনা!

শীতকালে মায়ের হাতের কুমড়াবড়ি ও লাল আলু দিয়ে রান্না করা শোল মাছের পদ অতুলনীয়।মাছের ঘাটি/ ঘন্ট উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে শীতকালে উল্লেখযোগ্য রন্ধনশৈলী।আইড় অথবা বোয়াল মাছ ও সিদ্ধ আলু ছিল এই রান্নার প্রধান উপকরণ।আবার কখনো আলুর সাথে বেগুন যোগ করা হতো কিংবা লাউ সাথে টাকী অথবা বোয়াল,আইড় মাছ।।রান্না শেষ হবার আগে পেয়াজ, জিরা, তেজপাতা ভেজে বেটে তরকারির ঝোলেন গুলিয়ে মিশিয়ে দেয়া হতো( ভাজনা)।হালে ওইসব মাছের জায়গা দখল করেছে রুই,সিলভারকার্পসহ অন্যান্য মাছ।যেগুলো কুলখানিতে খাওয়ানো হয়।সাথে দেয়া হয় ডেজার্ট হিসেবে দেয়া হয় পায়েস।বিভিন্ন মজলিসে এমনভাবে ঘাটি ও পায়েস পরিবেশন করা হয় যেন বস্সারে.. সাদেক আলী,খাবি কত খাহ!আমি ভাজনা বাটাতে পটু ছিলাম।তেজপাতাগুলো চুড়মুড় করে ভেঙ্গে কিছুটা পানি নিয়ে ক্রমাগত বেটে একটা মোলায়েম পেস্ট তৈরি করা।

শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম ঝরনা ফুফু হারিকেনের গ্লাস মুছতে মুছতে খাবার জন্য বলছেন।রোদে পিঠ দিয়ে গরমভাতের সাথে নতুন আলুভর্তা,টাকীমাছের ভর্তা,সীমআলু ভাজি আর শিং মাগুর,গুচি,বাইম,কই মাছ আলুর ভাজনা দেয়া ঝালে ঝোলের তরকারি ডালেরবড়ি, ফুলকপি করলামাছের সেই নষ্টালজিয়ায় কিংবা নতুন আলুতে দেশি মোরগের তরকারির টানে মায়ের আঁচলে বন্দী হতে মন চায়! মন ছুটেছে সেথায়….

চলবে..