বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জোড়া মোরগের বিনিময়ে মিলবে নিরাময় !

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৬:২০:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুন ২০২১
  • ৬২ Time View

 শারমিন লোপা.

কুসংস্কার এক ভয়ানক ব্যধি । যে রোগের কোন প্রতিষেধক নাই,একমাত্র সচেতনতাই পারে এই রোগ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে।এক জোড়া মোরগ বা রাজহাঁসের বিনিময়ে মিলবে ভুত পেতনি থেকে মুক্তি । কিংবা নতুন শাড়ি কাপড়ের সাথে হাদিয়া হিসেবে আসে বেশ বড় অঙ্কের টাকা। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যে মানুষ কুসংস্কারকে প্রাধান্য দেয় সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

এটা ভৌতিক কোন গল্পের কথা বলছি না , বলছি গুরুদাসপুরের মশিন্দা ইউনিয়নের দড়ি-বামনকোলা গ্রামের নবীজানের কথা । পেশায় গৃহিণী হলেও পাশাপাশি সে বহু বছর ধরে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করে আসছে । কিছুদিন আগের ঘটনা । আমার এক দুরসম্পর্কের  আত্মীয়ের শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুকে সুস্থ করে দিবে বলে সে টাকা ও জোড়া রাজহাঁস নেয়। কিছুদিন আগেই এমন আরো অনেক ঘটনা আমার কানে আসে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও নিজের চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আইনের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে মাঝে মাঝে কিছু এডভেঞ্চার করার ভুত চাপে মাথায়।

যেই ভাবা সেই কাজ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম বড় আপুকে সাথে নিয়ে মশিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই মোঃ চান আলীর স্ত্রী নবীজানের বাড়িতে নিজের চোখে দেখবো বলে। কিভাবে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা চলছে। পুরো ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি । মহিলার একটা একতলা পাকা বাড়ি আছে । তার শয়ন ঘরে বসার সুযোগ মিললো আমাদের দুই বোনের। বসার পরেই প্রশ্ন সমস্যা কি ?

বললাম রাতে স্বপ্নের মধ্যে ভয়ে চিৎকার করে উঠি ,ছায়ার মত কি একটা দেখি,  (আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার কোন সমস্যা নাই আমি পুরাপুরি সুস্থ)  মাথা ভারি হয়ে থাকে । এবার মহিলা বললো আসন পাততে হবে । উনার সাথে নাকি কি যেন  আছে সেই বলে দিবে রোগের সমাধান। আমি বললাম ঠিক আছে আসন পাতলে দেখা যাবে আমার কি হয়েছে । বলল টাকা দিতে হবে । আমি  বললাম আপনি নাকি টাকা নেন না (প্রথমে বলেছিল আমি টাকা নেই না)।

বললেন, আমি তো নিবো না আমার সাথে আমার যে গুরু ( আধ্যাতিক কিছু কথা বলেছিল) আছে উনি নেন। আসনে না দিলে হাজির হবে না। ঠিক আছে এই নেন বলে আমি টাকা দিলাম ।এবার শুরু হয়ে গেলো নবীজানের নতুন নাটক ।বিছানার উপরে টাকাটা রেখে নবীজান মনে মনে কিছু বলা শুরু করে দিলো। মিনিট খানেক পরে হাল্কা কাপুনি দিয়ে তার মাথা ঝুকিয়ে বললো আপনার সমস্যা কি বলেন । আমি আবার বললাম আমি ঘুমের মাঝে চিৎকার করি ,মাথা ব্যাথা,মাথা ভারি হয়ে থাকে।

সে বলে আমাকে নাকি কিসে আছর করেছে ।  যদি সেটা না সারাই তাহলে সে (কল্পিত জীব)আমাকে ঘুমের মাঝেই মেরে ফেলবে। আমার ছোট বেলা থেকেই নাকি আমাকে ভুত আছর করে রাখছে । খুব কষ্টে নিজের হাসি  চাপিয়ে রাখলাম । আর মনে মনে বললাম মহিলা হাই লেভেলের চিটিংবাজ। তারপর বললো সে নাকি তার গুরুকে ঢাকাতে পাঠিয়ে দিবে হাওয়ার মাধ্যমে যেন আমার সমস্যা সমাধান হয়। সাথে আমাকে তাবিজ আর তার বিখ্যাত পানি পড়া  দিয়ে দিলো আর বলে দিলো দুই সপ্তাহ যেন গরুর মাংস না খাই। এরপর বের হয়ে চলে আসলাম আমরা ।আসলে আমাদের কাজ শেষ তাই চলে আসতে হলো। ডাক্তারদের মতো পরবর্তীতে দেখা করতেও বলে দিলো ।

বিকেলের ঘটনাটা আরো ভয়ানক। নবীজানকে আমি কল দিলাম তার নাম্বারে। যথারীতি মহিলাকে এবার নিজের আসল পরিচয় দিলাম আর বললাম আমার কোন সমস্যা নাই । আপনি যে চিটিংবাজ আমি তা জেনেই আপানার কাছে গিয়ে মিথ্যে বলেছি। মহিলা একটু হতচকিয়ে গিয়ে বললো আমি যা ঠিক তাই বলছি । আমি বললাম আমার তো কোন অসুখ নাই তখন মহিলা এবার আমাকে উলটা  জবাব দেয় আপনি তাহলে কেন আমাকে মিথ্যা বললেন।

আমি বললাম আমি মিথ্যা না বললে তো বুঝতাম না যে আপনি কত বড় ঠকবাজ।কিভাবে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা পরিচালনা করেন। আমি বললাম লোক ঠকানোর ব্যবসা বাদ দেন নইলে আমি আপনার নামে নালিশ করবো ইউএনও অফিসে । জানেন আপনার জেল হতে পারে । বলে কি হবে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে? আমাকে মানুষ ভালোবেসে হাঁস-মুরগী দেয় আমি তাদের সুস্থ করে দেই তাই। আমি পুলিশকে ভয় করি না। আপনি আপনার তিনশত বিশ টাকা ফেরত নিয়ে যান। এই হচ্ছে প্রতারক নবীজানের কাহিনী। আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগেও মানুষ কিভাবে প্রতারিত হচ্ছে।

আমি আমাদের স্থানীয় সরকার এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি । দ্রুত এই মহিলাসহ উপজেলা ব্যাপি যতগুলো ভন্ড কবিরাজ আছে । মানুষের জানমালের ক্ষতি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। নইলে আরো অনেকেই  এই কুসংস্কার এর অন্ধকারে ডুবে যাবে । পরিশেষে একটা কথাই বলবো  আসুন সবাই মিলে সুস্থ একটা সমাজ গড়ি, যে সমাজ হবে কুসংস্কার আর হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত।

লেখকঃ এলএলবি (অনার্স) এলএলএম ( বিইউপি)

Tag :

জোড়া মোরগের বিনিময়ে মিলবে নিরাময় !

Update Time : ০৬:২০:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুন ২০২১

 শারমিন লোপা.

কুসংস্কার এক ভয়ানক ব্যধি । যে রোগের কোন প্রতিষেধক নাই,একমাত্র সচেতনতাই পারে এই রোগ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে।এক জোড়া মোরগ বা রাজহাঁসের বিনিময়ে মিলবে ভুত পেতনি থেকে মুক্তি । কিংবা নতুন শাড়ি কাপড়ের সাথে হাদিয়া হিসেবে আসে বেশ বড় অঙ্কের টাকা। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যে মানুষ কুসংস্কারকে প্রাধান্য দেয় সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

এটা ভৌতিক কোন গল্পের কথা বলছি না , বলছি গুরুদাসপুরের মশিন্দা ইউনিয়নের দড়ি-বামনকোলা গ্রামের নবীজানের কথা । পেশায় গৃহিণী হলেও পাশাপাশি সে বহু বছর ধরে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করে আসছে । কিছুদিন আগের ঘটনা । আমার এক দুরসম্পর্কের  আত্মীয়ের শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুকে সুস্থ করে দিবে বলে সে টাকা ও জোড়া রাজহাঁস নেয়। কিছুদিন আগেই এমন আরো অনেক ঘটনা আমার কানে আসে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও নিজের চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আইনের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে মাঝে মাঝে কিছু এডভেঞ্চার করার ভুত চাপে মাথায়।

যেই ভাবা সেই কাজ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম বড় আপুকে সাথে নিয়ে মশিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই মোঃ চান আলীর স্ত্রী নবীজানের বাড়িতে নিজের চোখে দেখবো বলে। কিভাবে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা চলছে। পুরো ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি । মহিলার একটা একতলা পাকা বাড়ি আছে । তার শয়ন ঘরে বসার সুযোগ মিললো আমাদের দুই বোনের। বসার পরেই প্রশ্ন সমস্যা কি ?

বললাম রাতে স্বপ্নের মধ্যে ভয়ে চিৎকার করে উঠি ,ছায়ার মত কি একটা দেখি,  (আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার কোন সমস্যা নাই আমি পুরাপুরি সুস্থ)  মাথা ভারি হয়ে থাকে । এবার মহিলা বললো আসন পাততে হবে । উনার সাথে নাকি কি যেন  আছে সেই বলে দিবে রোগের সমাধান। আমি বললাম ঠিক আছে আসন পাতলে দেখা যাবে আমার কি হয়েছে । বলল টাকা দিতে হবে । আমি  বললাম আপনি নাকি টাকা নেন না (প্রথমে বলেছিল আমি টাকা নেই না)।

বললেন, আমি তো নিবো না আমার সাথে আমার যে গুরু ( আধ্যাতিক কিছু কথা বলেছিল) আছে উনি নেন। আসনে না দিলে হাজির হবে না। ঠিক আছে এই নেন বলে আমি টাকা দিলাম ।এবার শুরু হয়ে গেলো নবীজানের নতুন নাটক ।বিছানার উপরে টাকাটা রেখে নবীজান মনে মনে কিছু বলা শুরু করে দিলো। মিনিট খানেক পরে হাল্কা কাপুনি দিয়ে তার মাথা ঝুকিয়ে বললো আপনার সমস্যা কি বলেন । আমি আবার বললাম আমি ঘুমের মাঝে চিৎকার করি ,মাথা ব্যাথা,মাথা ভারি হয়ে থাকে।

সে বলে আমাকে নাকি কিসে আছর করেছে ।  যদি সেটা না সারাই তাহলে সে (কল্পিত জীব)আমাকে ঘুমের মাঝেই মেরে ফেলবে। আমার ছোট বেলা থেকেই নাকি আমাকে ভুত আছর করে রাখছে । খুব কষ্টে নিজের হাসি  চাপিয়ে রাখলাম । আর মনে মনে বললাম মহিলা হাই লেভেলের চিটিংবাজ। তারপর বললো সে নাকি তার গুরুকে ঢাকাতে পাঠিয়ে দিবে হাওয়ার মাধ্যমে যেন আমার সমস্যা সমাধান হয়। সাথে আমাকে তাবিজ আর তার বিখ্যাত পানি পড়া  দিয়ে দিলো আর বলে দিলো দুই সপ্তাহ যেন গরুর মাংস না খাই। এরপর বের হয়ে চলে আসলাম আমরা ।আসলে আমাদের কাজ শেষ তাই চলে আসতে হলো। ডাক্তারদের মতো পরবর্তীতে দেখা করতেও বলে দিলো ।

বিকেলের ঘটনাটা আরো ভয়ানক। নবীজানকে আমি কল দিলাম তার নাম্বারে। যথারীতি মহিলাকে এবার নিজের আসল পরিচয় দিলাম আর বললাম আমার কোন সমস্যা নাই । আপনি যে চিটিংবাজ আমি তা জেনেই আপানার কাছে গিয়ে মিথ্যে বলেছি। মহিলা একটু হতচকিয়ে গিয়ে বললো আমি যা ঠিক তাই বলছি । আমি বললাম আমার তো কোন অসুখ নাই তখন মহিলা এবার আমাকে উলটা  জবাব দেয় আপনি তাহলে কেন আমাকে মিথ্যা বললেন।

আমি বললাম আমি মিথ্যা না বললে তো বুঝতাম না যে আপনি কত বড় ঠকবাজ।কিভাবে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা পরিচালনা করেন। আমি বললাম লোক ঠকানোর ব্যবসা বাদ দেন নইলে আমি আপনার নামে নালিশ করবো ইউএনও অফিসে । জানেন আপনার জেল হতে পারে । বলে কি হবে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে? আমাকে মানুষ ভালোবেসে হাঁস-মুরগী দেয় আমি তাদের সুস্থ করে দেই তাই। আমি পুলিশকে ভয় করি না। আপনি আপনার তিনশত বিশ টাকা ফেরত নিয়ে যান। এই হচ্ছে প্রতারক নবীজানের কাহিনী। আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগেও মানুষ কিভাবে প্রতারিত হচ্ছে।

আমি আমাদের স্থানীয় সরকার এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি । দ্রুত এই মহিলাসহ উপজেলা ব্যাপি যতগুলো ভন্ড কবিরাজ আছে । মানুষের জানমালের ক্ষতি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। নইলে আরো অনেকেই  এই কুসংস্কার এর অন্ধকারে ডুবে যাবে । পরিশেষে একটা কথাই বলবো  আসুন সবাই মিলে সুস্থ একটা সমাজ গড়ি, যে সমাজ হবে কুসংস্কার আর হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত।

লেখকঃ এলএলবি (অনার্স) এলএলএম ( বিইউপি)