শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজশাহীর ৮ জেলাতেই ছড়িয়েছে করোনা, যেসব কারণে বাড়ছে সংক্রমণ

  • Reporter Name
  • Update Time : ১২:১৬:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২
  • ৩৪ Time View

রাজশাহীতে আরও বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। বিভাগের আট জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। স্বাস্থ্যবিধি না মানা, মাস্ক পরিধান না করা, হাটবাজার, অফিস-আদালতে অবাধ বিচরণ, জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলেও নমুনা পরীক্ষা না করা, জেলায় আক্রান্ত রোগীরা পরিবহনযোগে বিভাগীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসায় এবং মানুষের অসচেতনতার কারণে দ্রুতগতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীনতাকে মোটাদাগে দায়ী করছেন তারা।

মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে রাজশাহীর দুটি ল্যাবে ৩৪৪ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এদিন ৫৮৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষা হিসাবে শনাক্তের হার ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর আগের দিন সোমবার (২৪ জানুয়ারি) রাজশাহীর দুটি ল্যাবে ৩০৪ জনের শরীরে মিলেছে করোনাভাইরাস। এদিন ৫৪৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষা হিসাবে শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবে ১৭৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত হয় ১১৭ জনের। একই সময়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ল্যাবে ৪০৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা ধরা পড়ে ২২৭ জনের। এবার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারা এবং রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। মঙ্গলবার তাদের নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হয়। সাবেক এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারা ঢাকায় আছেন। দলীয় নেতাকর্মীরা তার করোনা আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের করোনা পজিটিভ আসে।

মঙ্গলবার বিকালে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) নাজমা আক্তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগে প্রতিদিনই করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে আরও ৮৮২ জনের। নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এক হাজার ৮২৮ জনের, করোনা শনাক্তের হার ৪৮ দশমিক ২৫। এর আগের দিন ৩৯ দশমিক ৩১ ছিল বিভাগে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। টানা পাঁচ দিন পর গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় বগুড়া জেলায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।

করোনা পরীক্ষা করাতে দীর্ঘ লাইন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) আগের দিনের তুলনায় নমুনা পরীক্ষা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৮২৮ জনের নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮৮২ জনের। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ৪৮ দশমিক ২৫। এটি মহামারি করোনা শুরুর পর থেকে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ৩৯ দশমিক ৩১। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় বিভাগে নমুনা পরীক্ষা কমলেও করোনা শনাক্ত বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে করোনা শনাক্তের হার।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বিভাগের আট জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনার সংক্রমণ। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী জেলায়, শনাক্ত হারে এগিয়ে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী জেলায় ৫৮৭ নমুনা পরীক্ষায় ৩২৫ জন (শনাক্ত হার ৫৫ দশমিক ৩৭), চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪৩ নমুনা পরীক্ষায় ২৬ (৬০ দশমিক ৪৬ শতাংশ), নওগাঁয় ১৫৫ নমুনা পরীক্ষায় ৭৬ (৪৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ), নাটোরে ৬৫ নমুনা পরীক্ষায় ৩১ (৪৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ)।

এছাড়া জয়পুরহাটে ১৯৩ নমুনা পরীক্ষায় ৪৪ জন (২২ দশমিক ৭৯ শতাংশ), বগুড়ায় ৩৯৮ নমুনা পরীক্ষায় ২০০ জন (৫০ দশমিক ২৫ শতাংশ), সিরাজগঞ্জে ১৬৫ নমুনা পরীক্ষায় ৭১ জন (৪৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ) ও পাবনায় ২২২ নমুনা পরীক্ষায় ১০৯ জনের (৪৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ) করোনা শনাক্ত হয়েছে।

করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেও রাজশাহীতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, রাস্তাঘাট ও পরিবহনগুলোতে মাস্ক ছাড়ায় চলাচল করতে দেখা গেছে। এছাড়া অফিসগুলোতে সেবাদানকারীরা দূরত্ব বজায় রাখলেও গ্রহীতাদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরাতে অনীহা দেখা গেছে। কারও কারও মুখে মাস্ক থাকলেও নাক অথবা থুতনিতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, অফিসগুলোতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, রাজশাহী পোস্ট অফিস (জিপিও), রাজশাহী রেলওয়ে, বিভিন্ন ব্যাংক, রেলওয়ে স্টেশন ছাড়াও নগরীর বিনোদপুর, ভদ্রা, শিরোইল বাসস্ট্যান্ড, গোরহাঙ্গা চত্বর ঘুরে দেখা গেছে, সেবাদানকারী-সেবাগ্রহীতা, যাত্রী, চালক ও পথচারীদের মুখে মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্ব মানতে দেখা যায়নি কাউকে। কিছু কিছু স্থানে অনেককেই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প আর আড্ডা দিতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অনেকের মাস্ক থাকলেও মুখে ছিল না।

রাজশাহী পোস্ট অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মাস্ক নেই। যাদের মুখে আছে, তাদের আবার যথাযথ স্থানে নেই। অনেকের নাকের নিচে নামানো ছিল মাস্ক।

জিপিও অফিসের ভেতরে মাস্ক ছাড়া নিজের মধ্যে কথা বলতে দেখা গেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এছাড়া জিপিওতে সেবা নিতে আসা মানুষগুলোকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের ঠাসাঠাসি লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে দেখা গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে। গেটে ছিল না হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা। শিক্ষাবোর্ড চত্বরে মাস্ক ছাড়া ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে মানুষকে। অফিস কক্ষগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মাস্ক থাকলেও যথাযথ স্থানে ছিল না।

এছাড়া শিক্ষাবোর্ডে সেবাগ্রহীতাদের সামাজিক দূরত্ব মানতে দেখা যায়নি। তারা একে অপরের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করছেন। এছাড়া বোর্ডের স্টাফদের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই মাস্ক পরেছেন থুতনির নিচে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। রাজশাহী রেলওয়ের জিএম অফিসে ঢুকতে হাতের ডানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হলেও পানি আর সাবানের ব্যবস্থা ছিল না। বেশ কয়েকটি বেসিন বসানো থাকলে পানির লাইন ছিল না।

অন্যদিকে, সড়কে অটোরিকশাচালক ও যাত্রীদের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। অটোরিকশাগুলোতে সামনা-সামনি বসে থাকা কারও মুখে মাস্ক আছে, কারও মুখে নেই। এভাবে যাত্রা করতে দেখা গেছে সবাইকে।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনা আক্রান্তের ভয়াবহতার দিক দিয়ে রাজশাহী রেড জোনে। জেলায় প্রতিদিনই করোনা শনাক্তের হার বাড়ছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে উপসর্গ নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় তিন জন মারা গেছেন। সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা একেবারেই অনুপস্থিতির কারণে শনাক্তের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা গেলে সংক্রমণ কমে আসবে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, জনগণ ধরেই নিয়েছে ওমিক্রনে মানুষ আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগছে না কিংবা মারা যাচ্ছে না। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের মধ্যে বেশ অনীহা তৈরি হয়েছে। কিন্তু জনগণের এমন ধারণা ভুল। কারণ করোনা যেকোনও সময় মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন হতে হবে। তা না হলে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট চালিয়ে কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মাইকিং করিয়ে কোনও লাভ হবে না। স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করায় জরিমানা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করতে নিয়মিত মাইকিংও করা হচ্ছে।

অটোরিকশাচালক রবিউল ইসলাম বলেন, মাস্ক পরার চেষ্টা করি; যাত্রীদেরও বলি। কিন্তু কোনও যাত্রী মাস্ক না পরলে তো জোর করা যায় না। অনেকেই আবার শোনার পরে মাস্ক পরেন।

মাস্ক ছাড়া চালক ও যাত্রী
বাসের যাত্রী সবুর রহমান বলেন, আমি চশমা ব্যবহার করি। তাই মাস্ক পরলে চশমার কাচ আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এমনভাবে আমার কয়েকটা চশমা নষ্ট হয়েছে। তাই মাস্ক না পরে খুলে রেখেছি।

রাজশাহী বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক টিটো জানান, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। সেই লক্ষ্যে বাসস্ট্যান্ডগুলোতে মাইকিং করা হবে যাত্রী ও চালকদের সচেতন করার জন্য।

Tag :
About Author Information

Daily Banalata

রাজশাহীর ৮ জেলাতেই ছড়িয়েছে করোনা, যেসব কারণে বাড়ছে সংক্রমণ

Update Time : ১২:১৬:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২

রাজশাহীতে আরও বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। বিভাগের আট জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। স্বাস্থ্যবিধি না মানা, মাস্ক পরিধান না করা, হাটবাজার, অফিস-আদালতে অবাধ বিচরণ, জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলেও নমুনা পরীক্ষা না করা, জেলায় আক্রান্ত রোগীরা পরিবহনযোগে বিভাগীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসায় এবং মানুষের অসচেতনতার কারণে দ্রুতগতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীনতাকে মোটাদাগে দায়ী করছেন তারা।

মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে রাজশাহীর দুটি ল্যাবে ৩৪৪ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এদিন ৫৮৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষা হিসাবে শনাক্তের হার ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর আগের দিন সোমবার (২৪ জানুয়ারি) রাজশাহীর দুটি ল্যাবে ৩০৪ জনের শরীরে মিলেছে করোনাভাইরাস। এদিন ৫৪৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষা হিসাবে শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবে ১৭৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত হয় ১১৭ জনের। একই সময়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ল্যাবে ৪০৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা ধরা পড়ে ২২৭ জনের। এবার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারা এবং রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। মঙ্গলবার তাদের নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হয়। সাবেক এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারা ঢাকায় আছেন। দলীয় নেতাকর্মীরা তার করোনা আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের করোনা পজিটিভ আসে।

মঙ্গলবার বিকালে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) নাজমা আক্তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগে প্রতিদিনই করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে আরও ৮৮২ জনের। নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এক হাজার ৮২৮ জনের, করোনা শনাক্তের হার ৪৮ দশমিক ২৫। এর আগের দিন ৩৯ দশমিক ৩১ ছিল বিভাগে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। টানা পাঁচ দিন পর গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় বগুড়া জেলায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।

করোনা পরীক্ষা করাতে দীর্ঘ লাইন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) আগের দিনের তুলনায় নমুনা পরীক্ষা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৮২৮ জনের নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮৮২ জনের। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ৪৮ দশমিক ২৫। এটি মহামারি করোনা শুরুর পর থেকে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ৩৯ দশমিক ৩১। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় বিভাগে নমুনা পরীক্ষা কমলেও করোনা শনাক্ত বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে করোনা শনাক্তের হার।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বিভাগের আট জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনার সংক্রমণ। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী জেলায়, শনাক্ত হারে এগিয়ে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী জেলায় ৫৮৭ নমুনা পরীক্ষায় ৩২৫ জন (শনাক্ত হার ৫৫ দশমিক ৩৭), চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪৩ নমুনা পরীক্ষায় ২৬ (৬০ দশমিক ৪৬ শতাংশ), নওগাঁয় ১৫৫ নমুনা পরীক্ষায় ৭৬ (৪৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ), নাটোরে ৬৫ নমুনা পরীক্ষায় ৩১ (৪৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ)।

এছাড়া জয়পুরহাটে ১৯৩ নমুনা পরীক্ষায় ৪৪ জন (২২ দশমিক ৭৯ শতাংশ), বগুড়ায় ৩৯৮ নমুনা পরীক্ষায় ২০০ জন (৫০ দশমিক ২৫ শতাংশ), সিরাজগঞ্জে ১৬৫ নমুনা পরীক্ষায় ৭১ জন (৪৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ) ও পাবনায় ২২২ নমুনা পরীক্ষায় ১০৯ জনের (৪৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ) করোনা শনাক্ত হয়েছে।

করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেও রাজশাহীতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, রাস্তাঘাট ও পরিবহনগুলোতে মাস্ক ছাড়ায় চলাচল করতে দেখা গেছে। এছাড়া অফিসগুলোতে সেবাদানকারীরা দূরত্ব বজায় রাখলেও গ্রহীতাদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরাতে অনীহা দেখা গেছে। কারও কারও মুখে মাস্ক থাকলেও নাক অথবা থুতনিতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, অফিসগুলোতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, রাজশাহী পোস্ট অফিস (জিপিও), রাজশাহী রেলওয়ে, বিভিন্ন ব্যাংক, রেলওয়ে স্টেশন ছাড়াও নগরীর বিনোদপুর, ভদ্রা, শিরোইল বাসস্ট্যান্ড, গোরহাঙ্গা চত্বর ঘুরে দেখা গেছে, সেবাদানকারী-সেবাগ্রহীতা, যাত্রী, চালক ও পথচারীদের মুখে মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্ব মানতে দেখা যায়নি কাউকে। কিছু কিছু স্থানে অনেককেই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প আর আড্ডা দিতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অনেকের মাস্ক থাকলেও মুখে ছিল না।

রাজশাহী পোস্ট অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মাস্ক নেই। যাদের মুখে আছে, তাদের আবার যথাযথ স্থানে নেই। অনেকের নাকের নিচে নামানো ছিল মাস্ক।

জিপিও অফিসের ভেতরে মাস্ক ছাড়া নিজের মধ্যে কথা বলতে দেখা গেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এছাড়া জিপিওতে সেবা নিতে আসা মানুষগুলোকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের ঠাসাঠাসি লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে দেখা গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে। গেটে ছিল না হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা। শিক্ষাবোর্ড চত্বরে মাস্ক ছাড়া ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে মানুষকে। অফিস কক্ষগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মাস্ক থাকলেও যথাযথ স্থানে ছিল না।

এছাড়া শিক্ষাবোর্ডে সেবাগ্রহীতাদের সামাজিক দূরত্ব মানতে দেখা যায়নি। তারা একে অপরের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করছেন। এছাড়া বোর্ডের স্টাফদের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই মাস্ক পরেছেন থুতনির নিচে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। রাজশাহী রেলওয়ের জিএম অফিসে ঢুকতে হাতের ডানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হলেও পানি আর সাবানের ব্যবস্থা ছিল না। বেশ কয়েকটি বেসিন বসানো থাকলে পানির লাইন ছিল না।

অন্যদিকে, সড়কে অটোরিকশাচালক ও যাত্রীদের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। অটোরিকশাগুলোতে সামনা-সামনি বসে থাকা কারও মুখে মাস্ক আছে, কারও মুখে নেই। এভাবে যাত্রা করতে দেখা গেছে সবাইকে।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনা আক্রান্তের ভয়াবহতার দিক দিয়ে রাজশাহী রেড জোনে। জেলায় প্রতিদিনই করোনা শনাক্তের হার বাড়ছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে উপসর্গ নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় তিন জন মারা গেছেন। সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা একেবারেই অনুপস্থিতির কারণে শনাক্তের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা গেলে সংক্রমণ কমে আসবে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, জনগণ ধরেই নিয়েছে ওমিক্রনে মানুষ আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগছে না কিংবা মারা যাচ্ছে না। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের মধ্যে বেশ অনীহা তৈরি হয়েছে। কিন্তু জনগণের এমন ধারণা ভুল। কারণ করোনা যেকোনও সময় মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন হতে হবে। তা না হলে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট চালিয়ে কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মাইকিং করিয়ে কোনও লাভ হবে না। স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করায় জরিমানা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করতে নিয়মিত মাইকিংও করা হচ্ছে।

অটোরিকশাচালক রবিউল ইসলাম বলেন, মাস্ক পরার চেষ্টা করি; যাত্রীদেরও বলি। কিন্তু কোনও যাত্রী মাস্ক না পরলে তো জোর করা যায় না। অনেকেই আবার শোনার পরে মাস্ক পরেন।

মাস্ক ছাড়া চালক ও যাত্রী
বাসের যাত্রী সবুর রহমান বলেন, আমি চশমা ব্যবহার করি। তাই মাস্ক পরলে চশমার কাচ আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এমনভাবে আমার কয়েকটা চশমা নষ্ট হয়েছে। তাই মাস্ক না পরে খুলে রেখেছি।

রাজশাহী বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক টিটো জানান, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। সেই লক্ষ্যে বাসস্ট্যান্ডগুলোতে মাইকিং করা হবে যাত্রী ও চালকদের সচেতন করার জন্য।