শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ

সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করলে সবাই এগিয়ে আসে- ইবি নির্যাতিত ছাত্রী ফুলপরী

  • Reporter Name
  • Update Time : ১১:৫৬:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ৮ Time View

বিশেষ প্রতিবেদক আটঘরিয়া. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর। নির্যাতিত হওয়ার পর ভেঙে পড়লেও পরিবারের অনুপ্রেরণায় ঘুরে দাঁড়ান ফুলপরী। নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান লিখিতভাবে।সেই সাথে পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সহপাঠীদের সহযোগিতাও।

 

ফুলপরী বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে নির্যাতনের ঘটনার পাশাপাশি নানা বিষয় তুলে ধরেন। এ ঘটনায় চারটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে । এখন পর্যন্ত তদন্ত নিয়ে সন্তুষ্ট তিনি। দ্রুত তদন্ত শেষে দোষী সবার শাস্তি নিশ্চিতের দাবিও জানান তিনি।

ফুলপরীর বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার শিবপুর গ্রামে। সেখানে তাঁর বাবা-মা ও দুই ভাই থাকেন। এক বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। বড় ভাই হযরত আলী লেখাপড়া শেষ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোট ভাই চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। তাঁদের পরিবার এলাকার অনেকের কাছেই অনুকরণীয়।

বাবা ভ্যানচালক আতাউর রহমান ছেলেমেয়েকে কষ্ট বুঝতে দেননি কখনোই। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে- এই চিন্তা থেকেই যা আয় করেন সংসার চালানোর পাশাপাশি খরচ করেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে।

বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা এমন নির্যাতনের ঘটনায় প্রথমদিকে বেশ ভেঙে পড়েন। পরে সাহস দেন মেয়েকে, নিজেও শক্ত হন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে মেয়েকে অভিযোগ দিতে সাহস দেন তিনি। আর এই সাহসেই ঘুরে দাঁড়ান ফুলপরী।

গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফুলপরী জানান, ‘একাধিক তদন্ত দল তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে, তিনি তাদের বিস্তারিত জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তদন্ত দল যেভাবে কাজ করছে তাতে তিনি সন্তুষ্ট। তবে ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটির ওপর তার তেমন কোনো আস্থা নেই।’ ফুলপরী বলেন, অন্যায় যা হয়েছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, সব কথা প্রকাশ্যে বলা কঠিন। অন্যায় যার সঙ্গেই হোক, এর প্রতিবাদ চলতে থাকবে। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে যাবেন এখন থেকে। তাঁর নিজের সঙ্গে যা হয়েছে, তা যে কোন সময় যে কারও সঙ্গে হতে পারে। চুপ থাকলেই তারা সাহস পেয়ে যাবে। সাহস করে প্রতিবাদ করলে তখন সবাই এগিয়ে আসে। হলগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোর যে অলিখিত খবরদারি থাকে, সেটাও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

এর আগে শিবপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে তাঁর ওপর বর্বর নির্যাতন করা হয়েছে। চিরতরে র‌্যাগিংয়ের অবসান চান তিনি ও তাঁর পরিবার। ফুলপরী বলেন, ‘আমার ওপর যে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়, অথচ আমার বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না। বিকৃত সুখ পেতে এ ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে। আমার জামা ওপরের দিকে তুলে ধরতে বাধ্য করা হয় এবং তারা ভিডিও করে। এটা কোন ধরনের র‌্যাগিং?’ তাঁকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ২০৬ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে গণরুমে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। তারা চড়-লাথি মারে। সবার পায়ে ধরলেও তারা বলে র‌্যাগিং কাকে বলে দ্যাখ, তুই বেশি বেড়ে গেছিস। রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত তারা নির্যাতন চালায়। পিন দিয়ে চোখ ফুটো করার চেষ্টা করে। কান্না করতে মুখের মধ্যে গামছা এঁটে দেয়। এ ছাড়া বাজে ভাষা ব্যবহার করে প্রভোস্ট স্যারসহ বিভিন্ন জনের নামে কথা বলতে বাধ্য করে এবং ভিডিও করা হয়। তারা কথা বললেও মারে, না বললেও মারে। তিনি বলেন, এ ধরনের র‌্যাগিং আর চাই না। আমার মতো অনেক নিরীহ মেয়ে পড়াশোনা করতে আসে। অনেকে র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বাড়ি চলে গেছে অথবা নীরবে অত্যাচার সহ্য করেছে। এর সুষ্ঠু বিচার চাই। র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন চিরতরে বন্ধ করা উচিত।

ফুলপরীর বাবা ভ্যানচালক আতাউর রহমান বলেন, ‘আমি ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই। ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। ৭ ফেব্রুয়ারি ফুলপরী বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি তার ক্লাস ছিল। হোস্টেলের মেয়েরা বিনা কারণে আমার মেয়েকে মেরেছে। অনেক অত্যাচার করেছে। কার কাছে গিয়ে এই নির্যাতনের বিচার চাইব। আমি দেশবাসীর কাছে বিচার ও দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই।
ফুলপরীর মা তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘ওই ঘটনার পর থেকে আমার মেয়েও খুব ভয় পাচ্ছে। বমি করছে। কেমন জানি হয়ে গেছে। এই নির্যাতনের বিচার চাই।’ ফুলপরীর বড় ভাই হযরত আলী বলেন, ‘আমার নিরীহ বোনকে নির্যাতনের বিচার চাই। র‌্যাগিং একেবারে বন্ধ চাই।’

Tag :
Popular Post

সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করলে সবাই এগিয়ে আসে- ইবি নির্যাতিত ছাত্রী ফুলপরী

Update Time : ১১:৫৬:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

বিশেষ প্রতিবেদক আটঘরিয়া. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর। নির্যাতিত হওয়ার পর ভেঙে পড়লেও পরিবারের অনুপ্রেরণায় ঘুরে দাঁড়ান ফুলপরী। নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান লিখিতভাবে।সেই সাথে পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সহপাঠীদের সহযোগিতাও।

 

ফুলপরী বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে নির্যাতনের ঘটনার পাশাপাশি নানা বিষয় তুলে ধরেন। এ ঘটনায় চারটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে । এখন পর্যন্ত তদন্ত নিয়ে সন্তুষ্ট তিনি। দ্রুত তদন্ত শেষে দোষী সবার শাস্তি নিশ্চিতের দাবিও জানান তিনি।

ফুলপরীর বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার শিবপুর গ্রামে। সেখানে তাঁর বাবা-মা ও দুই ভাই থাকেন। এক বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। বড় ভাই হযরত আলী লেখাপড়া শেষ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোট ভাই চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। তাঁদের পরিবার এলাকার অনেকের কাছেই অনুকরণীয়।

বাবা ভ্যানচালক আতাউর রহমান ছেলেমেয়েকে কষ্ট বুঝতে দেননি কখনোই। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে- এই চিন্তা থেকেই যা আয় করেন সংসার চালানোর পাশাপাশি খরচ করেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে।

বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা এমন নির্যাতনের ঘটনায় প্রথমদিকে বেশ ভেঙে পড়েন। পরে সাহস দেন মেয়েকে, নিজেও শক্ত হন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে মেয়েকে অভিযোগ দিতে সাহস দেন তিনি। আর এই সাহসেই ঘুরে দাঁড়ান ফুলপরী।

গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফুলপরী জানান, ‘একাধিক তদন্ত দল তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে, তিনি তাদের বিস্তারিত জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তদন্ত দল যেভাবে কাজ করছে তাতে তিনি সন্তুষ্ট। তবে ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটির ওপর তার তেমন কোনো আস্থা নেই।’ ফুলপরী বলেন, অন্যায় যা হয়েছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, সব কথা প্রকাশ্যে বলা কঠিন। অন্যায় যার সঙ্গেই হোক, এর প্রতিবাদ চলতে থাকবে। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে যাবেন এখন থেকে। তাঁর নিজের সঙ্গে যা হয়েছে, তা যে কোন সময় যে কারও সঙ্গে হতে পারে। চুপ থাকলেই তারা সাহস পেয়ে যাবে। সাহস করে প্রতিবাদ করলে তখন সবাই এগিয়ে আসে। হলগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোর যে অলিখিত খবরদারি থাকে, সেটাও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

এর আগে শিবপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে তাঁর ওপর বর্বর নির্যাতন করা হয়েছে। চিরতরে র‌্যাগিংয়ের অবসান চান তিনি ও তাঁর পরিবার। ফুলপরী বলেন, ‘আমার ওপর যে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়, অথচ আমার বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না। বিকৃত সুখ পেতে এ ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে। আমার জামা ওপরের দিকে তুলে ধরতে বাধ্য করা হয় এবং তারা ভিডিও করে। এটা কোন ধরনের র‌্যাগিং?’ তাঁকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ২০৬ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে গণরুমে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। তারা চড়-লাথি মারে। সবার পায়ে ধরলেও তারা বলে র‌্যাগিং কাকে বলে দ্যাখ, তুই বেশি বেড়ে গেছিস। রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত তারা নির্যাতন চালায়। পিন দিয়ে চোখ ফুটো করার চেষ্টা করে। কান্না করতে মুখের মধ্যে গামছা এঁটে দেয়। এ ছাড়া বাজে ভাষা ব্যবহার করে প্রভোস্ট স্যারসহ বিভিন্ন জনের নামে কথা বলতে বাধ্য করে এবং ভিডিও করা হয়। তারা কথা বললেও মারে, না বললেও মারে। তিনি বলেন, এ ধরনের র‌্যাগিং আর চাই না। আমার মতো অনেক নিরীহ মেয়ে পড়াশোনা করতে আসে। অনেকে র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বাড়ি চলে গেছে অথবা নীরবে অত্যাচার সহ্য করেছে। এর সুষ্ঠু বিচার চাই। র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন চিরতরে বন্ধ করা উচিত।

ফুলপরীর বাবা ভ্যানচালক আতাউর রহমান বলেন, ‘আমি ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই। ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। ৭ ফেব্রুয়ারি ফুলপরী বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি তার ক্লাস ছিল। হোস্টেলের মেয়েরা বিনা কারণে আমার মেয়েকে মেরেছে। অনেক অত্যাচার করেছে। কার কাছে গিয়ে এই নির্যাতনের বিচার চাইব। আমি দেশবাসীর কাছে বিচার ও দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই।
ফুলপরীর মা তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘ওই ঘটনার পর থেকে আমার মেয়েও খুব ভয় পাচ্ছে। বমি করছে। কেমন জানি হয়ে গেছে। এই নির্যাতনের বিচার চাই।’ ফুলপরীর বড় ভাই হযরত আলী বলেন, ‘আমার নিরীহ বোনকে নির্যাতনের বিচার চাই। র‌্যাগিং একেবারে বন্ধ চাই।’