বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সম্প্রীতির বন্ধন হোক ঈদুল ফিতর

মোঃ মাজেম আলী মলিন. দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আনন্দের বার্তা নিয়ে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। পবিত্র রমজানের শুরু থেকেই ঈদুল ফিতরের পবিত্র এ দিনটির জন্য বিশ্বজুড়ে অপেক্ষা করে ধর্মপ্রাণ মুসলমান সম্প্রদায়। যে যার সাধ্যমতো এই দিনটি আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করে থাকেন। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয় ঈদ আনন্দ। এই আনন্দ সবার সাথে ভাগ করে নিতে পথের বিড়ম্বনা অগ্রাহ্য করে সবাই ছুটে যান স্বজনের কাছে।

ঈদ শব্দটির আরবি শব্দমূল আউদ। এর অর্থ যা ফিরে আসে বারবার । ফিতর শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া, ইফতার করা। ঈদুল ফিতর মানে সে আনন্দঘন উৎসব, যা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে। আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীরঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে আসে এই ঈদ। ঈদ আসে শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুত্ব ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। ঈদ আসে মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে, পরিশোধিত হৃদয়ে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লাগাতে।

ঈদুল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটো সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনা ও সংযম পালনের পর শাওয়াল মাসের ১ তারিখে সিয়াম ভঙ্গ করে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যাওয়ার আনন্দময় দিবসটি ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত।

ধর্মীয় পরিভাষায় একে ইয়াউমুল জায়েজ অর্থাৎ পুরস্কারের দিবস হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর মুসলমানরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনসহ আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে। শ্রেণিবৈষম্য বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতা মুক্ত সুনির্মল আনন্দে ভরা সুস্নিগ্ধ, প্রীতি-সঘন মিলন উৎসব ঈদুল ফিতর। উল্লেখ্য যে, ইসলাম ধর্মীয় উৎসব বলে ঈদুল ফিতর প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এবং ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে।

মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিনটি অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদ। রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয়। এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। সারা বিশ্বের মুসলমানের সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব ঈদুল ফিতর। বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে কোলাকুলি, সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করেন।

ঈদের দিন মসজিদে, ময়দানে ঈদের নামাজে বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির সমাগম হয়ে থাকে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে,পরিচিত-অপরিচিত সবাই সানন্দে কোলাকুলি করেন। দেশের সকল ঈদগাহ ও মসজিদে ঈদের জামাতে পার্থিব সুখ-শান্তি, স্বস্তি আর পারলৌকিক মুক্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি এবং দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর উত্তরোত্তর শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও সংহতি কামনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবালবৃদ্ধবনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়।

মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা হলো, জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি মুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দের বন্ধন দৃঢ়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যমন্ডিত হোক! হাসি-খুশি ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। তাই আসুন, ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার মনেপ্রাণে। বুকে বুক মিলিয়ে আসুন সবাই এক হয়ে যাই।

ঈদের চাঁদ দেখার সময়কার আনন্দমুখর পরিবেশকে নিয়ে লেখা ও সুর করা কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি বেশ জনপ্রিয়। ঈদের দিনে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এই গানটি বাজানো হয়। আমাদের জীবনে ঈদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদ এলেই আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি কেনাকাটায়। সামর্থ্যানুযায়ী চলে কেনাকাটা। বিত্তবানদের অনেকেই কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটান। আমাদের সমাজে সুবিধাবঞ্চিত, আশ্রয়হীন ও অসহায় মানুষের সংখ্যা অগণিত। তাদের প্রতি আমাদের রয়েছে সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আরএটা হলো ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য।

সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সেজন্য রমজান মাসে বেশি হারে দান-খয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য। এ ছাড়া ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো, এক রাস্তা দিয়ে ঈদের মাঠে গমন এবং নামাজ শেষে ভিন্ন পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন। এ ছাড়া সর্বাগ্রে অজু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিধানও রয়েছে। ইসলামে নতুন পোশাক পরিধান করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিভিন্ন দেশে তা বহুল প্রচলিত একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে।

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। আমাদের মধ্যে কেউ যখন মনের খায়েশ মেটাতে ব্যস্ত, তখন একমুঠো খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন কেউ কেউ। আমরা তাদের সারা বছরের বস্ত্রের সংকুলান হয়তো করতে পারব না, কিন্তু ঈদ উপলক্ষ করে সামর্থ্য অনুযায়ী অন্তত একজন অসহায় শিশুর পাশে দাঁড়াতে তো পারি। আমাদের নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীদের মধ্যেও থাকতে পারে এমন অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও মানুষ। তাদের কথাও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের একটু সুদৃষ্টি অসংখ্য অসহায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তাই মুসলমানদের জীবনে ঈদের তাৎপর্য অনেক।

ঈদুল ফিতরের দিনে দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে; যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহতায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে অপচয়ে মত্ত হয় এক স্তরের মানুষ এই ঈদকে কেন্দ্র করে। আর পাশের বাড়ির মানুষটি না খেয়ে থাকলেও খবর রাখে না কেউ। তাই বিভেদ ভুলে ঈদ হোক সমতার। ঈদ হোক সম্প্রীতির ও ভ্রাতৃত্বের।

ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি-সৌভ্রাতৃত্ব শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষও এই উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের আরো কাছাকাছি আসে। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। পবিত্র রমজান আমাদের চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, ঈদুল ফিতর হচ্ছে সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর দিন। আজ একটি দিনের জন্য হলেও ধনী-গরিব সবাই দাঁড়াবে এক কাতারে। ভুলে যেতে হবে সব বৈষম্য, সব ভেদাভেদ। হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে সারা বিশ্বে মুসলমানদের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। ইসলাম যে প্রকৃত অর্থেই শান্তির ধর্ম, সেটি প্রমাণ করতে হবে। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে সবাই ভুলে যাক হিংসা-বিদ্বেষ। আমাদের ঘরে ঘরে ফিরে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

Tag :
About Author Information

Daily Banalata

সম্প্রীতির বন্ধন হোক ঈদুল ফিতর

Update Time : ১১:২৮:০২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৩

মোঃ মাজেম আলী মলিন. দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আনন্দের বার্তা নিয়ে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। পবিত্র রমজানের শুরু থেকেই ঈদুল ফিতরের পবিত্র এ দিনটির জন্য বিশ্বজুড়ে অপেক্ষা করে ধর্মপ্রাণ মুসলমান সম্প্রদায়। যে যার সাধ্যমতো এই দিনটি আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করে থাকেন। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয় ঈদ আনন্দ। এই আনন্দ সবার সাথে ভাগ করে নিতে পথের বিড়ম্বনা অগ্রাহ্য করে সবাই ছুটে যান স্বজনের কাছে।

ঈদ শব্দটির আরবি শব্দমূল আউদ। এর অর্থ যা ফিরে আসে বারবার । ফিতর শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া, ইফতার করা। ঈদুল ফিতর মানে সে আনন্দঘন উৎসব, যা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে। আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীরঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে আসে এই ঈদ। ঈদ আসে শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুত্ব ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। ঈদ আসে মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে, পরিশোধিত হৃদয়ে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লাগাতে।

ঈদুল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটো সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনা ও সংযম পালনের পর শাওয়াল মাসের ১ তারিখে সিয়াম ভঙ্গ করে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যাওয়ার আনন্দময় দিবসটি ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত।

ধর্মীয় পরিভাষায় একে ইয়াউমুল জায়েজ অর্থাৎ পুরস্কারের দিবস হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর মুসলমানরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনসহ আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে। শ্রেণিবৈষম্য বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতা মুক্ত সুনির্মল আনন্দে ভরা সুস্নিগ্ধ, প্রীতি-সঘন মিলন উৎসব ঈদুল ফিতর। উল্লেখ্য যে, ইসলাম ধর্মীয় উৎসব বলে ঈদুল ফিতর প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এবং ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে।

মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিনটি অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদ। রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয়। এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। সারা বিশ্বের মুসলমানের সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব ঈদুল ফিতর। বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে কোলাকুলি, সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করেন।

ঈদের দিন মসজিদে, ময়দানে ঈদের নামাজে বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির সমাগম হয়ে থাকে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে,পরিচিত-অপরিচিত সবাই সানন্দে কোলাকুলি করেন। দেশের সকল ঈদগাহ ও মসজিদে ঈদের জামাতে পার্থিব সুখ-শান্তি, স্বস্তি আর পারলৌকিক মুক্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি এবং দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর উত্তরোত্তর শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও সংহতি কামনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবালবৃদ্ধবনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়।

মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা হলো, জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি মুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দের বন্ধন দৃঢ়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যমন্ডিত হোক! হাসি-খুশি ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। তাই আসুন, ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার মনেপ্রাণে। বুকে বুক মিলিয়ে আসুন সবাই এক হয়ে যাই।

ঈদের চাঁদ দেখার সময়কার আনন্দমুখর পরিবেশকে নিয়ে লেখা ও সুর করা কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি বেশ জনপ্রিয়। ঈদের দিনে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এই গানটি বাজানো হয়। আমাদের জীবনে ঈদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদ এলেই আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি কেনাকাটায়। সামর্থ্যানুযায়ী চলে কেনাকাটা। বিত্তবানদের অনেকেই কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটান। আমাদের সমাজে সুবিধাবঞ্চিত, আশ্রয়হীন ও অসহায় মানুষের সংখ্যা অগণিত। তাদের প্রতি আমাদের রয়েছে সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আরএটা হলো ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য।

সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সেজন্য রমজান মাসে বেশি হারে দান-খয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য। এ ছাড়া ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো, এক রাস্তা দিয়ে ঈদের মাঠে গমন এবং নামাজ শেষে ভিন্ন পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন। এ ছাড়া সর্বাগ্রে অজু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিধানও রয়েছে। ইসলামে নতুন পোশাক পরিধান করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিভিন্ন দেশে তা বহুল প্রচলিত একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে।

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। আমাদের মধ্যে কেউ যখন মনের খায়েশ মেটাতে ব্যস্ত, তখন একমুঠো খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন কেউ কেউ। আমরা তাদের সারা বছরের বস্ত্রের সংকুলান হয়তো করতে পারব না, কিন্তু ঈদ উপলক্ষ করে সামর্থ্য অনুযায়ী অন্তত একজন অসহায় শিশুর পাশে দাঁড়াতে তো পারি। আমাদের নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীদের মধ্যেও থাকতে পারে এমন অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও মানুষ। তাদের কথাও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের একটু সুদৃষ্টি অসংখ্য অসহায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তাই মুসলমানদের জীবনে ঈদের তাৎপর্য অনেক।

ঈদুল ফিতরের দিনে দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে; যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহতায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে অপচয়ে মত্ত হয় এক স্তরের মানুষ এই ঈদকে কেন্দ্র করে। আর পাশের বাড়ির মানুষটি না খেয়ে থাকলেও খবর রাখে না কেউ। তাই বিভেদ ভুলে ঈদ হোক সমতার। ঈদ হোক সম্প্রীতির ও ভ্রাতৃত্বের।

ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি-সৌভ্রাতৃত্ব শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষও এই উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের আরো কাছাকাছি আসে। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। পবিত্র রমজান আমাদের চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, ঈদুল ফিতর হচ্ছে সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর দিন। আজ একটি দিনের জন্য হলেও ধনী-গরিব সবাই দাঁড়াবে এক কাতারে। ভুলে যেতে হবে সব বৈষম্য, সব ভেদাভেদ। হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে সারা বিশ্বে মুসলমানদের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। ইসলাম যে প্রকৃত অর্থেই শান্তির ধর্ম, সেটি প্রমাণ করতে হবে। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে সবাই ভুলে যাক হিংসা-বিদ্বেষ। আমাদের ঘরে ঘরে ফিরে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।