বসন্ত মানেই এক নতুন প্রাণের সঞ্চার। প্রকৃতিতে শীতের ম্লানতা কাটিয়ে নতুন করে রঙের উৎসব শুরু হয়। এ সময় গাছের ডালে নতুন পাতা গজায়, ফুলে ফুলে ভরে ওঠে চারপাশ, আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মন মাতানো সৌরভ। প্রকৃতির এই রূপবদল নিয়ে বিশ্লেষকদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কেউ একে জলবায়ুগত পরিবর্তনের স্বাভাবিক চক্র হিসেবে দেখেন, কেউবা এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের সম্পর্ক খুঁজে পান।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বসন্তকাল এক বিশেষ ঋতুগত পরিবর্তনের সময়। শীতকালে দিন ছোট এবং রাত দীর্ঘ হয়, সূর্যের তেজ কম থাকায় তাপমাত্রাও নিচে নেমে যায়। বসন্ত এলেই পৃথিবীর কক্ষপথের অবস্থানের কারণে সূর্যের আলো ও তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এতে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে। গাছপালার পুনর্জীবন শীতের কারণে অনেক গাছ তাদের পাতা ঝরিয়ে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে যায়। তবে বসন্তে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে, ফলে নতুন পাতা ও কুঁড়ি গজাতে শুরু করে। ফুল ফোটা ও পরাগায়ন বৃদ্ধি বসন্তের উষ্ণতা পরাগায়নকারী পতঙ্গদের সক্রিয় করে, যার ফলে ফুল ফোটার হার বেড়ে যায়। মৌমাছি, প্রজাপতির মতো পরাগায়নকারী প্রাণীরা এই মৌসুমে বেশি পরিমাণে ফুলের মধু সংগ্রহ করে, যা উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। প্রাণিজগতের পরিবর্তন শীতের ঘুম থেকে প্রাণীরা জেগে ওঠে। পাখিরা নতুন আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে ডিম পাড়ার জন্য বাসা বাঁধতে শুরু করে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বসন্তকে প্রজনন ঋতু হিসেবেও বেছে নেয়।
অপরদিকে সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বসন্ত শুধু প্রকৃতির পরিবর্তন নয়, মানুষের মনোজগতে, সংস্কৃতিতে এবং সমাজব্যবস্থায়ও পরিবর্তন নিয়ে আসে। উৎসব ও আনন্দ বিশ্বজুড়ে বসন্তকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে পহেলা ফাল্গুন ও দোলযাত্রা (হোলি) অন্যতম। চীন ও জাপানে বসন্ত উৎসব পালিত হয়। এসব উৎসবের মূল উপজীব্যই প্রকৃতির নবজাগরণ উদযাপন। মানসিক পরিবর্তন গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে অনেক মানুষ বিষণ্নতায় ভোগেন। বসন্ত এলে দিন দীর্ঘ হয়, সূর্যের আলো বেশি পাওয়া যায়, যা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতা কবি-সাহিত্যিকরা বসন্তকে ভালোবাসার, নতুন সম্ভাবনার এবং রঙের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে আধুনিক কবিরাও বসন্তের রঙ, গন্ধ ও আবেগকে শব্দের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।এককথায় বসন্ত প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি, যা কেবল পরিবেশগত পরিবর্তন নয়, বরং মানুষের জীবনযাত্রায়ও প্রভাব ফেলে। এটি একদিকে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের নতুন জীবনযাত্রা শুরু করে, অন্যদিকে মানুষের সংস্কৃতি ও মানসিকতায় আশার সঞ্চার করে। তাই বসন্তকে প্রকৃতির নবজাগরণের ঋতু বলা হয়, যা বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক—সব দিক থেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ সময়।
অপরদিকে বাংলারসাহিত্যিকরা বসন্তকে নানা রূপে চিত্রিত করেছেন, প্রেমিকদের হৃদয়ে এ ঋতু সৃষ্টি করেছে আবেগের ঢেউ। বাংলা কবিতা ও সাহিত্যে বসন্তের রঙ বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্তকে যেমন প্রকৃতির নবজাগরণ হিসেবে দেখেছেন, তেমনি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বসন্ত এসেছে এক বিষণ্ণ অথচ গভীর প্রেমের প্রতীক হয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্তের আবেগময়তা তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়— “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো তাপসনিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে” এখানে বসন্তের শেষে আগত গ্রীষ্মের বার্তা থাকলেও, প্রকৃতির রূপান্তর এবং তার সাথে মানুষের মনে যে উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়, তা স্পষ্ট। বসন্ত শুধু প্রকৃতির পরিবর্তন নয়, এটি মানুষের মনেরও নবজীবনের ইঙ্গিত বহন করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বসন্ত কখনো বেদনাময় হয়ে ধরা দেয়, প্রেমের এক অপূর্ণতা যেন ঘিরে ধরে প্রকৃতিকে “বসন্ত এসে গেছে, তার ফুলগুলি গেছে ঝরে; সেদিন তুমি ছিলে, আজ তোমার অভাব ভরে।” এখানে বসন্ত শুধু প্রেমের নয়, সময়ের প্রবাহে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিরও প্রতীক। প্রেমিকের হৃদয়ে বসন্ত প্রেমিকদের কাছে বসন্ত মানেই নতুন প্রেমের আরাধনা, কিংবা পুরনো প্রেমের নতুন রূপ। শিমুল ফুলের তীব্র লাল রং যেন হৃদয়ের অগ্নি, যা প্রেমিকের মনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। প্রেমিক-প্রেমিকারা বসন্তে প্রকৃতির সাথে নিজেদের ভালোবাসাকে মিলিয়ে নেয়। প্রেমিকা শিমুল ফুলের মতো লাল শাড়ি পরে বসন্ত বরণে নামে, আর প্রেমিকের চোখে সেই সৌন্দর্য হয়ে ওঠে কবিতা। শেক্সপিয়রের মতে, ” প্রকৃত প্রেম চিত্তের অনুভূতি, দৃষ্টির নয়। বসন্তের মতো প্রেমও অন্তরের গভীরে বসবাস করে, শুধু বাহ্যিক রূপের ওপর নির্ভরশীল নয়। শিমুল ফুল ও বসন্তের আবেগ শিমুল ফুল বসন্তের এক অনন্য প্রতীক। বসন্তে এই লাল ফুলের উপস্থিতি একদিকে প্রেমের প্রতীক, অন্যদিকে বিরহেরও স্মারক। গ্রামবাংলায় শিমুল গাছের নিচে প্রেমিক-প্রেমিকারা বসে স্বপ্ন বোনে, আবার কোনো কোনো প্রেমিকের মনে শিমুল ফুল পড়ে থাকা মানেই কোনো হারানো প্রেমের স্মৃতি। শিমুল ফুল যেমন সুন্দর, তেমনি এর কাঁটাযুক্ত গাছ প্রেমের জটিলতাকে বুঝিয়ে দেয়। প্রেম যেমন সুখের, তেমনি তাতে দুঃখের ছোঁয়াও থাকে। তাই শিমুল ফুল বসন্তে প্রেমের উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি ব্যথারও পরিচায়ক। বসন্ত প্রকৃতি ও প্রেমের এক অনন্য ঋতু। কবি-সাহিত্যিকদের কাছে এটি নবজীবনের প্রতীক, প্রেমিকদের হৃদয়ে এটি ভালোবাসার সময়। শিমুল ফুলের তীব্র লাল রঙ যেমন উষ্ণতার অনুভূতি জাগায়, তেমনি বসন্তের বাতাস প্রেমের সুর বয়ে আনে। বাংলা সাহিত্যে বসন্তের সৌন্দর্য ও আবেগ চিরকাল ধরে কবিতায়, গানে ও উপন্যাসে বহমান থাকবে। বসন্তের শিমুল ফুলের নিচে বসে হয়তো কোনো প্রেমিক কবিতা লিখছে, আর কোনো কবি বসন্তের প্রেমকে নতুন ভাষায় বন্দী করছে। বসন্ত মানেই প্রেম, কবিতা, আর নতুন জীবনের বার্তা। শিমুল ফুলের নিচে বসন্তের প্রেম বসন্ত এলেই প্রকৃতির রঙ বদলে যায়, চারদিকে লাল শিমুল ফুলের উজ্জ্বল শিখা যেন হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। গাছের ডালে ডালে ফুটে ওঠা এই ভালোবাসার রঙ তখন প্রেমিক-প্রেমিকার মনের মধ্যে অদৃশ্য এক সেতু বন্ধন গড়ে তোলে। শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলে, চোখে একরাশ বসন্তের আলো। আমি যেন সেই হাসির মধ্যেই হারিয়ে গেলাম, যেমন করে বসন্তের বাতাস শিমুল ফুলের পাপড়িগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায় দূরে কোথাও। বসন্ত মানেই তো নতুন প্রেম, নতুন অনুভূতির গান। বসন্তের রূপকন্যা: শিমুল ফুলের লাল স্বপ্ন প্রথম পর্ব: রক্তিম ভালোবাসার কবিতা ফাল্গুনের বাতাসে এক ধরনের উষ্ণতা মিশে থাকে, যেন প্রেমিকের কণ্ঠে সোহাগী শব্দ। এই উষ্ণতার মাঝেই বসন্ত এসে মেলে ধরে তার রঙিন পসরা। আর সেই রঙের রাজ্যে যে ফুলটি প্রকৃতির রক্তিম অভিব্যক্তি হয়ে ফোটে, সেটাই শিমুল। প্রেমিকের আবেগের মতোই এটি আকস্মিকভাবে ফোটে, আর ঝরে যায় হঠাৎ করেই। শিমুল ফুলের এই ক্ষণস্থায়িত্ব প্রেমের এক ধরনের প্রতীক— যা গভীর, কিন্তু অনিশ্চিত। পুরনো বাংলা কবিতা আর গানেও শিমুলের প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। কখনো প্রেমিকার লাল শাড়ির রঙের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে শিমুলের লালিমাকে, কখনো বা প্রেমিকের হৃদয়ে দহন জাগানো অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে তার গাঢ় রঙের। তৃতীয় পর্ব: স্মৃতির পাতায় শিমুল গ্রামবাংলার অনেকেই শিমুল গাছকে ভালোবেসে মনের মধ্যে এক টুকরো বসন্তের স্মৃতি গেঁথে রাখেন। ছোটবেলার বিকেলগুলোতে গ্রামের নির্জন পথ ধরে হাঁটার সময় রাস্তার ধারে ছড়িয়ে থাকা শিমুল ফুলের পাপড়ি দেখে হৃদয়ে এক ধরনের শূন্যতা জাগে। শিমুলের সেই নিঃশব্দ সৌন্দর্যকে মনে হয় এক অনুচ্চারিত কবিতা, যা শুধু অনুভব করা যায়, বলা যায় না। চতুর্থ পর্ব: শিমুল, বসন্ত ও বাউল গান বাংলার বাউলগানেও শিমুল ফুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রেম, বিরহ আর বসন্তকে একসঙ্গে মিশিয়ে অনেক বাউলগান শিমুলের রূপকে ব্যবহার করেছে। মনে পড়ে লালন ফকিরের সেই আধ্যাত্মিক ভাবনা— যেখানে শিমুলের রক্তিমতা মানুষের হৃদয়ের গোপন যন্ত্রণার প্রতীক হয়ে ওঠে। পঞ্চম পর্ব: শিমুল ফুলের নিচে এক বিকেল একবার শিমুলের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ বোঝে, প্রকৃতি কতটা কবি হতে পারে। বাতাস যখন ফুলের গায়ে দোলা দিয়ে যায়, তখন মনে হয়, বসন্ত তার গোপন প্রেম নিবেদন করছে এই রূপকন্যার কাছে। তাই, যে ভালোবাসে প্রকৃতিকে, সে শিমুল ফুলের প্রেমে পড়বেই। এই বসন্তে একদিন শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দেখো— রক্তিম পাপড়ির মাঝে ছড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ কবিতার গল্প!